এই ভুবনমোহিনী সুন্দরী, যারে দেখিয়া চিত্রবিক্রেত্রী প্রণত হইল, রূপনগরের রাজার কন্যা চঞ্চলকুমারী। যাহারা এতক্ষণ বৃদ্ধাকে লইয়া রঙ্গ করিতেছিল, তাহারা তাঁহার সখীজন এবং দাসী। চঞ্চলকুমারী সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া, সেই রঙ্গ দেখিয়া নীরবে হাস্য করিতেছিলেন। এক্ষণে প্রাচীনাকে মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে গা?”
সখীগণ পরিচয় দিতে ব্যস্ত হইল। “উনি তসবির বেচিতে আসিয়াছেন |”
চঞ্চলকুমারী বলিল, “তা তোমরা এত হাসিতেছিলে কেন?”
কেহ কেহ কিছু কিছু অপ্রতিভ হইল। যিনি সহচরীকে ঝাড়ুদারি রসিকতাটা করিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, “আমাদের দোষ কি? আয়ি বুড়ী যত সেকেলে বাদশাহের তসবির আনিয়া দেখাইতেছিল–তাই আমরা হাসিতেছিলাম–আমাদের রাজারাজড়ার ঘরে শাহজাঁদা বাদশাহ, কি জাঁহাগীর বাদশাহর তসবির কি নাই?”
বৃদ্ধা কহিল, “থাকবে না কেন মা? একখানা থাকিলে কি আর একখানা নিতে নাই? আপনারা নিবেন না, তবে আমরা কাঙ্গাল গরিব প্রতিপালন হইব কি প্রকারে?”
রাজকুমারী তখন প্রাচীনার তসবির সকল দেখিতে চাহিলেন। প্রাচীনা একে একে তসবিরগুলি রাজকুমারীকে দেখাইতে লাগিল। আকবর বাদশাহ, জাহাঁগীর শাহজহাঁ, নুরজহাঁ, নুরমহালের চিত্র দেখাইল। রাজকুমারী হাসিয়া হাসিয়া সকলগুলি ফিরাইয়া দিলেন–বলিলেন, “ইহারা আমাদের কুটুম্ব, ঘরে ঢের তসবির আছে। হিন্দুরাজার তসবির আছে?”
“অভাব কি?” বলিয়া প্রাচীনা, রাজা মানসিংহ, রাজা বীরবল, রাজা জয়সিংহ প্রভৃতির চিত্র দেখাইল। রাজপুত্রী তাহাও ফিরাইয়া দিলেন, বলিলেন, “এও লইব না। এ সকল হিন্দু নয়, ইহারা মুসলমানের চাকর |”
প্রাচীনা তখন হাসিয়া বলিল, “মা, কে কার চাকর, তা আমি ত জানি না। আমার বা আছে, দেখাই, পসন্দ করিয়া লও |”
প্রাচীনা চিত্র দেখাইতে লাগিল। রাজকুমারী পসন্দ করিয়া রাণা প্রতাপ, রাণা অমরসিংহ, রাণা কর্ণ, যশোবন্ত সিংহ প্রভৃতি কয়খানি চিত্র ক্রয় করিলেন। একখানি বৃদ্ধা ঢাকিয়া রাখিল, দেখাইল না।
রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওখানি ঢাকিয়া রাখিলে যে?” বৃদ্ধা কথা কহে না। রাজকুমারী পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন।
বৃদ্ধা ভীতা হইয়া করযোড়ে কহিল, “আমার অপরাধ লইবেন না–অসাবধানে ঘটিয়াছে–অন্য তসবিরের সঙ্গে আসিয়াছে |”
রাজকুমারী বলিলেন, “অত ভয় পাইতেছ কেন? এমন কাহার তসবির যে, দেখাইতে ভয় পাইতেছ?”
বুড়ী। দেখিয়া কাজ নাই। আপনার ঘরের দুশমনের ছবি।
রাজকুমারী। কার তসবির?
বুড়ী। (সভয়ে) রাণা রাজসিংহের।
রাজকুমারী হাসিয়া বলিলেন, “বীরপুরুষ স্ত্রীজাতির কখনও শত্রু নহে। আমি ও তসবির লইব |”
তখন বৃদ্ধা রাজসিংহের চিত্র তাঁহার হস্তে দিল। চিত্র হাতে লইয়া রাজকুমারী অনেক্ষণ ধরিয়া তাহা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন; দেখিতে দেখিতে তাঁহার মুখ প্রফুল্ল হইল; লোচন বিস্ফারিত হইল। একজন সখী, তাঁহার ভাব দেখিয়া চিত্র দেখিতে চাহিল–রাজকুমারী তাহার হস্তে চিত্র দিয়া বলিলেন, “দেখ। দেখিবার যোগ্য বটে |”
সখীগণের হাতে হাতে সে চিত্র ফিরিতে লাগিল। রাজসিংহ যুবা পুরুষ নহে–তথাপি তাঁহার চিত্র দেখিয়া সকলে প্রশংসা করিতে লাগিল।
বৃদ্ধা সুযোগ পাইয়া এই চিত্রখানিতে দ্বিগুণ মুনাফা করিল। তার পর লোভ পাইয়া বলিল, “ঠাকুরাণি! যদি বীরের তসবির লইতে হয়, তবে আর একখানি দিতেছি। ইহার মত পৃথিবীতে বীর কে?”
এই বলিয়া বৃদ্ধা আর একখানি চিত্র বাহির করিয়া রাজপুত্রীর হাতে দিল।
রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কাহার চেহারা?”
বৃদ্ধা। বাদশাহ আলম্গীরের।
রাজকুমারী। কিনিব।
এই বলিয়া একজন পরিচারিকাকে রাজপুত্রী ক্রীত চিত্রগুলির মূল্য আনিয়া বৃদ্ধাকে বিদায় করিয়া দিতে বলিলেন। পরিচারিকা মূল্য আনিতে গেল, ইত্যবসরে রাজপুত্রী সখীগণকে বলিলেন, “এসো, একটু আমোদ করা যাক |”
রঙ্গপ্রিয়া বয়স্যাগণ বলিল, “কি আমোদ বল! বল!”
রাজপুত্রী বলিলেন, “আমি এই আলমগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি। সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের নাতি মার। কার নাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি |”
ভয়ে সখীগণের মুখ শুকাইয়া গেল। একজন বলিল, “অমন কথা মুখে আনিও না, কুমারীজি! কাক পক্ষীতে শুনিলেও, রূপনগরের গড়ের একখানি পাতর থাকিবে না |”
হাসিয়া রাজপুত্রী চিত্রখানি মাটিতে রাখিলেন, “কে নাতি মারিবি মার |”
কেহ অগ্রসর হইল না। নির্মল নাম্নী একজন বয়স্যা আসিয়া রাজকুমারীর মুখ টিপিয়া ধরিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, “অমন কথা আর বলিও না |”
চঞ্চলকুমারী ধীরে ধীরে অলঙ্কারশোভিত বাম চরণখানি ঔরঙ্গজেবের চিত্রের উপরে সংস্থাপিত করিলেন–চিত্রের শোভা বুঝি বাড়িয়া গেল। চঞ্চলকুমারী একটু হেলিলেন–মড় মড় শব্দ হইল–ঔরঙ্গজেব বাদশাহের প্রতিমূর্তি রাজপুতকুমারীর চরণতলে ভাঙ্গিয়া গেল।
“কি সর্বনাশ! কি করিলে!” বলিয়া সখীগণ শিহরিল।
রাজপুতকুমারী হাসিয়া বলিলেন, “যেমন ছেলেরা পুতুল খেলিয়া সংসারের সাধ মিটায়, আমি তেমনই মোগল বাদশাহের মুখে নাতি মারার সাধ মিটাইলাম |” তার পর নির্মলের মুখ চাহিয়া বলিলেন, “সখি নির্মল ! ছেলেদের সাধ মিটে; সময়ে তাহাদের সত্যের ঘর-সংসার হয়। আমার কি সাধ মিটিবে না? আমি কি কখন জীবন্ত ঔরঙ্গজেবের মুখে এইরূপ__”
নির্মল , রাজকুমারীর মুখ চাপিয়া ধরিলেন, কথাটা সমাপ্ত হইল না–কিন্তু সকলেই তাহার অর্থ বুঝিল। প্রাচীনার হৃদয় কম্পিত হইতে লাগিল–এমন প্রাণসংহারক কথাবার্তা যেখানে হয়, সেখান হইতে কতক্ষণে নিষ্কৃতি পাইবে! এই সময়ে তাহার বিক্রীত তসবিরের মূল্য আসিয়া পৌঁছিল। প্রাপ্তিমাত্র প্রাচীনা ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।
সে ঘরের বাহিরে আসিলে, নির্মল তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিয়া আসিল। আসিয়া তাহার হাতে একটি আশরফি দিয়া বলিল, “আয়ি বুড়ী, দেখিও, যাহা শুনিলে, কাহারও সাক্ষাতে মুখে আনিও না। রাজকুমারীর মুখের আটক নাই–এখনও উঁহার ছেলে বয়স |”
বুড়ী আশরফিটি লইয়া বলিল, “তা এ কি আর বলতে হয় মা! আমি তোমাদের দাসী–আমি কি এ সকল কথা মুখে আনি?”
নির্মল সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া গেলেন।
রাজসিংহ – ১.৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : চিত্রবিচারণ
পরদিন চঞ্চলকুমারী ক্রীত চিত্রগুলি একা বসিয়া মনোযোগের সহিত দেখিতেছিলেন। নির্মলকুমারী আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া চঞ্চল বলিল, “নির্মল ! ইহার মধ্যে কাহাকেও তোমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে?”
নির্মল বলিল, “যাহাকে আমার বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তাহার চিত্র ত তুমি পা দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছ |”
চ। ঔরঙ্গজেবকে!
নি । আশ্চর্য হইলে যে?
চ। বদ্জাতের ধাড়ি যে? অমন পাষণ্ড যে আর পৃথিবীতে জন্মে নাই?
নি । বদ্জাতকে বশ করিতেই আমার আনন্দ। তোমার মনে নাই, আমি বাঘ
পুষিতাম? আমি একদিন না একদিন ঔরঙ্গজেবকে বিবাহ করিব ইচ্ছা আছে।
চ। মুসলমান যে?
নি । আমার হাতে পড়িলে ঔরঙ্গজেবও হিন্দু হবে।
চ। তুমি মর।
নি । কিছুমাত্র আপত্তি নাই–কিন্তু ঐ একখানা কার ছবি তুমি পাঁচ বার করিয়া দেখিতেছ, সে খবরটা লইয়া তবে মরিব।
চঞ্চলকুমারী তখন আর পাঁচখানা চিত্রের মধ্যে ক্ষিপ্রহস্তে করস্থ চিত্রখানি মিশাইয়া দিয়া বলিল, “কোন্ ছবি আবার পাঁচ বার করিয়া দেখিতেছিলাম? মানুষে মানুষের একটা কলঙ্ক দিতে পারিলেই কি হয়? কোন্ ছবিখানা পাঁচ বার করিয়া দেখিতেছিলাম?” নির্মল হাসিয়া বলিল, “একখানা তসবির দেখিতেছিলে, তার আর কলঙ্ক কি? রাজকুমারী, তুমি রাগ করিলে বলিয়া আমার কাছে ধরা পড়িলে। কার এমন কপাল প্রসন্ন, তসবিরগুলা দেখিলে আমি খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি |”
চ। আকব্বর শাহের।
নি । আকব্বরের নামে রাজপুতনী ঝাড়ু মারে। তা ত নহেই।
এই বলিয়া নির্মলকুমারী তসবিরের গোছা হাতে লইয়া খুঁজিতে লাগিল। বলিল, “তুমি যেখানি দেখিতেছিলে, তাহার উল্টা পিঠে একটা কালো দাগ আছে দেখিয়াছি |” সেই চিহ্ন ধরিয়া, নির্মলকুমারী একখানা ছবি বাহির করিয়া চঞ্চলকুমারীর হাতে দিল, বলিল, “এইখানি |”
চঞ্চলকুমারী রাগ করিয়া ছবিখানি ফেলিয়া দিল। বলিল, “তোর আর কিছু কাজ নেই, তাই তুই লোককে জ্বালাতন করিতে আরম্ভ করেছিস। তুই দূর হ |”
নি । দূর হব না। তা, রাজকুঙার! এ বুড়ার ছবিতে দেখিবার তুমি এত কি পেয়েছ?
চ। বুড়ো! তোর কি চোখ গিয়েছে না কি?
নির্মল চঞ্চলকে জ্বালাইতেছিল, চঞ্চলের রাগ দেখিয়া টিপি টিপি হাসিতে লাগিল। নির্মল বড় সুন্দরী, মধুর সরস হাসিতে তাহার সৌন্দর্য বড় খুলিল। নির্মল হাসিয়া বলিল, “তা ছবিতে বুড়া না দেখাক–লোকে বলে, মহারাণা রাজসিংহের বয়স অনেক হয়েছে। তাঁর দুই পুত্র উপযুক্ত হইয়াছে |”
চ। ও কি রাজসিংহের ছবি? তা অত কে জানে সখি?
নি । কাল কিনেছ–আজ কিছু জান না সখি? তা মানুষটার বয়সও হয়েছে, এমন যে খুব সুপুরুষ, তাও নয়। তবে দেখিতেছিলে কি?
চ।
গৌরী সম্ ঝে ভসমভার
পিয়ারী সম্ ঝে কালা।
শচী সম্ ঝে সহস্রলোচন,
বীর সম্ ঝে বীরবালা ||