পঞ্চম পরিচ্ছেদ : আর একটি সংবাদ
সেই দিন মাধবাচার্যের পর্যটন সমাপ্ত হইল। তিনি নবদ্বীপে উপস্থিত হইলেন। তথায় প্রিয় শিষ্য হেমচন্দ্রেকে দর্শনদান করিয়া চরিতার্থ করিলেন। এবং আশীর্বাদ, আলিঙ্গন, কুশলপ্রশ্নাদির পরে বিরলে উভয়ের উদ্দেশ্য সাধনের কথোপকথন করিতে লাগিলেন।
আপন ভ্রমণবৃত্তান্ত সবিস্তারে বিবৃত করিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “এত শ্রম করিয়া কতকদূর কৃতকার্য হইয়াছি। এতদ্দেশে অধীন রাজগণের মধ্যে অনেকেই রণক্ষেত্রে সসৈন্যে সেন রাজার সহায়তা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন। অচিরাৎ সকলে আসিয়া নবদ্বীপে সমবেত হইবেন |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাঁহারা অদ্যই এ স্থলে না আসিলে সকলই বিফল হইবে। যবনসেনা আসিয়াছে, মহাবনে অবস্থিতি করিতেছে। আজি কালি নগর আক্রমণ করিবে |”
মাধবাচার্য শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “গৌড়েশ্বরের পক্ষ হইতে কি উদ্যম হইয়াছে?”
হে। কিছুই না। বোধ হয়, রাজসন্নিধানে এ সংবাদ এ পর্যন্ত প্রচার হয় নাই। আমি দৈবাৎ কালি এ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছি।
মা। এ বিষয় তুমি রাজগোচর করিয়া সৎপরামর্শ দাও নাই কেন?
হে। সংবাদপ্রাপ্তির পরেই পথিমধ্যে দস্যু কর্তৃক আহত হইয়া রাজপথে পড়িয়াছিলাম। এই মাত্র গৃহে আসিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতেছি। বলহানিপ্রযুক্ত রাজসমক্ষে যাইতে পারি নাই। এখনই যাইতেছি।
মা। তুমি এখন বিশ্রাম কর। আমি রাজার নিকট যাইতেছি। পশ্চাৎ যেরূপ হয় তোমাকে জানাইব।
এই বলিয়া মাধবাচার্য গাত্রোত্থান করিলেন।
তখন হেমচন্দ্র বলিলেন, “প্রভু! আপনি গৌড় পর্যন্ত গমন করিয়াছিলেন শুনিলাম___”
মাধবাচার্য অভিপ্রায় বুঝিয়া কহিলেন, “গিয়াছিলাম। তুমি মৃণালিনীর সংবাদ কামনা করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছ? মৃণালিনী তথায় নাই |”
হে। কোথায় গিয়াছে?
মা। তাহা আমি অবগত নহি, কেহ সংবাদ দিতে পারিল না।
হে। কেন গিয়াছে?
মা। বৎস! সে সকল পরিচয় যুদ্ধান্তে দিব।
হেমচন্দ্র ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “স্বরূপ বৃত্তান্ত আমাকে জানাইলে, আমি যে মর্মপীড়ায় কাতর হইব, সে আশঙ্কা করিবেন না। আমিও কিয়দংশ শ্রবণ করিয়াছি। যাহা অবগত আছেন, তাহা নি:সঙ্কোচে আমার নিকট প্রকাশ করুন |”
মাধবাচার্য গৌড়নগরে গমন করিলে হৃষীকেশ তাঁহাকে আপন জ্ঞানমত মৃণালিনীর বৃত্তান্ত জ্ঞাত করিয়াছিলেন। তাহাই প্রকৃত বৃত্তান্ত বলিয়া মাধবাচার্যেরও বোধ হইয়াছিল; মাধবাচার্য কস্মিন্কালে স্ত্রীজাতির অনুরাগী নহেন-সুতরাং স্ত্রীচরিত্র বুঝিতেন না। এক্ষণে হেমচন্দ্রের কথা শুনিয়া তাঁহার বোধ হইল যে, হেমচন্দ্র সেই বৃত্তান্তই কতক কতক শ্রবণ করিয়া মৃণালিনীর কামনা পরিত্যাগ করিয়াছেন-অতএব কোন নূতন মন:পীড়ার সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া, পুনর্বার আসনগ্রহণপূর্বক হৃষীকেশের কথিত বিবরণ হেমচন্দ্রকে শুনাইতে লাগিলেন।
হেমচন্দ্র অধোমুখে করতলোপরি ভ্রূকুটিকুটি ললাট সংস্থাপিত করিয়া নি:শব্দে সমুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন। মাধবাচার্যের কথা সমাপ্ত হইলেও বাঙ্কনিষ্পত্তি করিলেন না। সেই অবস্থাতেই রহিলেন। মাধবাচার্য ডাকিলেন, “হেমচন্দ্র!” কোন উত্তর পাইলেন না। পুনরপি ডাকিলেন, “হেমচন্দ্র!” তথাপি নিরুত্তর।
তখন মাধবাচার্য গাত্রোত্থান করিয়া হেমচন্দ্রের হস্ত ধারণ করিলেন; অতি কোমল, স্নেহময় স্বরে কহিলেন, “বৎস! তাত! মুখ তোল, আমার সঙ্গে কথা কও!”
হেমচন্দ্র মুখ তুলিলেন। মুখ দেখিয়া মাধবাচার্যও ভীত হইলেন। মাধবাচার্য কহিলেন, “আমার সহিত আলাপ কর। ক্রোধ হইয়া থাকে, তাহা ব্যক্ত কর |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “কাহার কথায় বিশ্বাস করিব? হৃষীকেশ একরূপ কহিয়াছে। ভিখারিণী আর এক প্রকার বলিল |”
মাধবাচার্য কহিলেন, “ভিখারিণী কে? সে কি বলিয়াছে?”
হেমচন্দ্র অতি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
মাধবাচার্য সঙ্কুচিত স্বরে কহিলেন, “হৃষীকেশেরই কথা মিথ্যা বোধ হয় |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “হৃষীকেশের প্রত্যক্ষ |”
তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। পিতৃদত্ত শূল হস্তে লইলেন। কম্পিত কলেবরে গৃহমধ্যে নি:শব্দে পাদচারণ করিতে লাগিলেন।
আচার্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছ?”
হেমচন্দ্র করস্থ শূল দেখাইয়া কহিলেন, “মৃণালিনীকে এই শূলে বিদ্ধ করিব |”
মাধবাচার্য তাঁহার মুখকান্তি দেখিয়া ভীত হইয়া অপসৃত হইলেন।
প্রাতে মৃণালিনী বলিয়া গিয়াছিলেন, “হেমচন্দ্র আমারই |”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : “আমি ত উন্মাদিনী”
অপরাহ্নে মাধবাচার্য প্রত্যাবর্তন করিলেন। তিনি সংবাদ আনিলেন যে, ধর্মাধিকার প্রকাশ করিয়াছেন, যবনসেনা আসিয়াছে বটে, কিন্তু পূর্বজিত রাজ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা শুনিয়া যবনসেনাপতি সন্ধিসংস্থাপনে ইচ্ছুক হইয়াছেন। আগামীকল্য তাঁহারা দূত প্রেরণ করিবেন। দূতের আগমন অপেক্ষা করিয়া কোন যুদ্ধোদ্যম হইতেছে না। এই সংবাদ দিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “এই কুলাঙ্গার রাজা ধর্মাধিকারের বুদ্ধিতে নষ্ট হইবে |”
কথা হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশলাভ করিল কি না সন্দেহ। তাঁহাকে বিমনা দেখিয়া মাধবাচার্য বিদায় হইলেন।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে মনোরমা হেমচন্দ্রের গৃহে প্রবেশ করিল। হেমচন্দ্রকে দেখিয়া মনোরমা কহিল, “ভাই! আজ তুমি অমন কেন?”
হে। কেমন আমি?
ম। তোমার মুখখানা শ্রাবণের আকাশের মত অন্ধকার; ভাদ্র মাসের গঙ্গার মত রাগে ভরা; অত ভ্রকুটি করিতেছ কেন? চক্ষের পলক নাই কেন-আর দেখি-তাই ত, চোখে জল; তুমি কেঁদেছ?
হেমচন্দ্র মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন; আবার চক্ষু অবনত করিলেন; পুনর্বার উন্নত গবাক্ষপথে দৃষ্টি করিলেন; আবার মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। মনোরমা বুঝিল যে, দৃষ্টির এইরূপ গতির কোন উদ্দেশ্য নাই। যখন কথা কণ্ঠাগত, অথচ বলিবার নহে, তখনই দৃষ্টি এইরূপ হয়। মনোরমা কহিল, “হেমচন্দ্র, তুমি কেন কাতর হইয়াছ? কি হইয়াছে?” হেমচন্দ্র কহিলেন, “কিছু না |”
মনোরমা প্রথমে কিছু বলিল না-পরে আপনা আপনি মৃদু মৃদু কথা কহিতে লাগিল। “কিছু না-বলিবে না! ছি! ছি! বুকের ভিতর বিছা পুষিবে!” বলিতে বলিতে চক্ষু দিয়া এক বিন্দু বারি বহিল;-পরে অকস্মাৎ হেমচন্দ্রের প্রতি মুখপ্রতি চাহিয়া কহিল, “আমাকে বলিবে না কেন? আমি যে তোমার ভগিনী |”
মনোরমার মুখের ভাবে, শান্তদৃষ্টিতে এত যত্ন, এত মৃদুতা, এত সহৃদয়তা প্রকাশ পাইল যে হেমচন্দ্রের অন্ত:করণ দ্রবীভূত হইল। তিনি কহিলেন, “আমার যে যন্ত্রণা, তাহা ভগিনীর নিকট কথনীয় নহে |”
মনোরমা কহিল, “তবে আমি ভগিনী নহি |”
হেমচন্দ্র কিছুতেই উত্তর করিলেন না। তথাপি প্রত্যাশাপন্ন হইয়া মনোরমা তাঁহার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিল। কহিল, “আমি তোমার কেহ নহি |”
হে। আমার দু:খ ভগিনীর অশ্রাব্য-অপরেরও অশ্রাব্য।
হেমচন্দ্রের কণ্ঠস্বর করুণাময়-নিতান্ত আধিব্যক্তিপরিপূর্ণ; তাহা মনোরমার প্রাণের ভিতর গিয়া বাজিল। তখনই সে স্বর পরিবর্তিত হইল, নয়নে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল-অধর দংশন করিয়া হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমার দু:খ কি? দু:খ কিছুই না। আমি মণি ভ্রমে কালসাপ কণ্ঠে ধরিয়াছিলাম, এখন তাহা ফেলিয়া দিয়াছি |”
মনোরমা আবার পূর্ববৎ হেমচন্দ্রের প্রতি অনিমেষলোচনে চাহিয়া রহিল। ক্রমে তাহার মুখমণ্ডলে অতি মধুর, অতি সকরুণ হাস্য প্রকটিত হইল। বালিকা প্রগল্াভতাপ্রাপ্ত হইল। সূর্যরশ্মির অপেক্ষা যে রশ্মি সমুজ্জ্বল, তাহার কিরীট পরিয়া প্রতিভাদেবী দেখা দিলেন। মনোরমা কহিল, “বুঝিয়াছি। তুমি না বুঝিয়া ভালবাস, তাহার পরিণাম ঘটিয়াছে |”
হে। ভালবাসিতাম।
হেমচন্দ্র বর্তমানের পরিবর্তে অতীতকাল ব্যবহার করিলেন। অমনি নীরবে নি:স্রুত অশ্রুজলে তাঁহার মুখমণ্ডল ভাসিয়া গেল।
মনোরমা বিরক্ত হইল। বলিল, “ছি! ছি! প্রতারণা! যে পরকে প্রতারণা করে, সে বঞ্চক মাত্র। যে আত্মপ্রতারণা তাহার নিকট সর্বনাশ ঘটে |” মনোরমা বিরক্তিবশত: আপন অলকদাম চম্পকাঙ্গুলিতে জড়িতে করিয়া টানিতে লাগিল।
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইলেন, কহিলেন, “কি প্রতারণা করিলাম?”
মনোরমা কহিল, “ভালবাসিতাম কি? তুমি ভালবাস। নহিলে কাঁদিলে কেন? কি? আজি তোমার স্নেহের পাত্র অপরাধী হইয়াছে বলিয়া তোমার ভালবাসা গিয়াছে? কে তোমায় এমন প্রবোধ দিয়াছে?” বলিতে বলিতে মনোরমার প্রৌঢ়ভাবাপন্ন মুখকান্তি সহসা প্রফুল্ল পদ্মবৎ অধিকতর পরিস্ফুট, আগ্রহকম্পিত হইতে লাগিল; বলিতে লাগিল, “এ কেবল বীরদম্ভকারী পুরুষদের দর্প মাত্র। অহঙ্কার করিয়া আগুন নিবান যায়? তুমি বালির বাঁধ দিয়া এই কূলপরিপ্লাবনী গঙ্গার বেগ রোধ করিতে পারিবে, তথাপি তুমি প্রণয়িনীকে পাপিষ্ঠা মনে করিয়া কখনও প্রণয়ের বেগ রোধ করিতে পারিবে না। হা কৃষ্ণ! মানুষ সকলেই প্রতারক!”
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন, “আমি ইহাকে এক দিন বালিকা মনে করিয়াছিলাম!”
মনোরমা কহিতে লাগিল, “তুমি পুরাণ শুনিয়াছ? আমি পণ্ডিতের নিকট তাহার গূঢ়ার্থ সহিত শুনিয়াছি। লেখা আছে, ভগীরথ গঙ্গা আনিয়াছিলেন; এক দাম্ভিক মত্ত হস্তী তাহার বেগ সংবরণ করিতে গিয়া ভাসিয়া গিয়াছিল। ইহার অর্থ কি? গঙ্গা প্রেমপ্রবাহস্বরূপ; ইহা জগদীশ্বর-পাদ-পদ্ম-নি:সৃত, ইহা জগতে পবিত্র – যে ইহাতে অবগাহন করে, সেই পূণ্যময় হয়। ইনি মৃত্যঞ্জয়-জটা-বিহারিণী; যে মৃত্যুকে জয় করিতে পারে, সেও প্রণয়কে মস্তকে ধারণ করে। আমি যেমন শুনিয়াছি, ঠিক সেইরূপ বলিতেছি। দাম্ভিক হস্তী দম্ভের অবতারস্বরূপ। সে প্রণয়বেগে ভাসিয়া যায়। প্রণয় প্রথমে একমাত্র পথ অবলম্বন করিয়া উপযুক্ত সময়ে শতমুখী হয়; প্রণয় স্বভাবসিদ্ধ হইলে, শত পাত্রে ন্যস্ত হয়-পরিশেষে সাগরসঙ্গমে লয়প্রাপ্ত হয়-সংসারস্থ সর্বজীবে বিলীন হয় |”
হে। তোমার উপদেষ্টা কি বলিয়াছেন, প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই? পাপাসক্তকে কি ভালবাসিতে হইবে?
ম। পাপাসক্তকে ভালবাসিতে হইবে। প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই। সকলকেই ভালবাসিবে, প্রণয় জন্মিলেই তাহাকে যত্নে স্থান দিবে; কেন না, প্রণয় অমূল্য। ভাই, যে ভাল, তাকে কে না ভালবাসে? যে মন্দ তাকে আপনা ভুলিয়া ভালবাসে আমি তাকে বড় ভালবাসি। কিন্তু আমি ত উন্মাদিনী।
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “মনোরমা, এ সকল তোমায় কে শিখাইল? তোমার উপদেষ্টা অলৌকিক ব্যক্তি |”
মনোরমা মুখাবনত করিয়া কহিলেন, “তিনি সর্বজ্ঞানী, কিন্তু___”
হে। কিন্তু কি?
ম। তিনি অগ্নিস্বরূপ-আলো করেন, কিন্তু দগ্ধও করেন।
মনোরমা ক্ষণেক মুখাবনত করিয়া নীরব হইয়া রহিল।
হেমচন্দ্র বলিলেন, “মনোরমা, তোমার মুখ দেখিয়া, আর তোমার কথা শুনিয়া, আমার বোধ হইতেছে, তুমিও ভালবাসিয়াছ। বোধ হয়, যাঁহাকে তুমি অগ্নির সহিত তুলনা করিলে, তিনিই তোমার প্রণয়াধিকারী |”
মনোরমা পূর্ববৎ নীরবে রহিল। হেমচন্দ্র পুনরপি বলিতে লাগিলেন, “যদি ইহা সত্য হয়, তবে আমার একটি কথা শুন। স্ত্রীলোকের সতীত্বের অধিক আর ধর্ম নাই; যে স্ত্রীর সতীত্ব নাই, সে শূকরীর অপেক্ষাও অধম। সতীত্বের হানি কেবল কার্যেই ঘটে, এমন নহে; স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষের চিন্তামাত্রও সতীত্বের বিঘ্ন। তুমি বিধবা, যদি স্বামী ভিন্ন অপরকে মনেও ভাব, তবে তুমি ইহলোকে পরলোকে স্ত্রীজাতির অধম হইয়া থাকিবে। অতএব সাবধান হও। যদি কাহারও প্রতি চিত্ত নিবিষ্ট থাকে, তবে তাহাকে বিস্মৃত হও |”
মনোরমা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল; পরে মুখে অঞ্চল দিয়া হাসিতে লাগিল, হাসি বন্ধ হয় না। হেমচন্দ্র কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইলেন, কহিলেন, “হাসিতেছ কেন?”
মনোরমা কহিলেন, “ভাই, এই গঙ্গাতীরে গিয়া দাঁড়াও; গঙ্গাকে ডাকিয়া কহ, গঙ্গে, তুমি পর্বতে ফিরে যাও |”
হে। কেন?
ম। স্মৃতি কি আপন ইচ্ছাধীন? রাজপুত্র, কালসর্পকে মনে করিয়া কি সুখ? কিন্তু তথাপি তুমি তাহাকে ভুলিতেছ না কেন?
হে। তাহার দংশনের জ্বালায়।
ম। আর সে যদি দংশন না করিত? তবে কি তাহাকে ভুলিতে?
হেমচন্দ্র উত্তর করিলেন না। মনোরমা বলিতে লাগিল, “তোমার ফুলের মালা কালসাপ হইয়াছে, তবু তুমি ভুলিতে পারিতেছ না; আমি, আমি ত পাগল-আমি আমার পুষ্পহার কেন ছিঁড়িব? ”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এক প্রকার অন্যায় বলিতেছ না। বিস্মৃতি স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া নহে; লোক আত্মগরিমায় অন্ধ হইয়া পরের প্রতি যে সকল উপদেশ করে, তন্মধ্যে ‘বিস্মৃত হও’ এই উপদেশের অপেক্ষা হাস্যাস্পদ আর কিছুই নাই। কেহ কাহাকে বলে না, অর্থচিন্তা ছাড়; যশের ইচ্ছা ছাড়; জ্ঞানচিন্তা ছাড়; ক্ষুধানিবারণেচ্ছা ত্যাগ কর; নিদ্রা ছাড়; তবে কেন বলিবে, ভালবাসা ছাড়? ভালবাসা কি এ সকল অপেক্ষা ছোট? এ সকল অপেক্ষা প্রণয় ন্যূন নহে-কিন্তু ধর্মের অপেক্ষা ন্যূন বটে। ধর্মের জন্য প্রেমকে সংহার করিবে। স্ত্রীর পরম ধর্ম সতীত্ব। সেই জন্য বলিতেছি, যদি পার, প্রেম সংহার কর |”
ম। আমি অবলা; জ্ঞানহীনা; বিবশা; আমি ধর্মাধর্ম কাহাকে বলে, তাহা জানি না। আমি এইমাত্র জানি, ধর্ম ভিন্ন প্রেম জন্মে না।
হে। সাবধান, মনোরমা! বাসনা হইতে ভ্রান্তি জন্মে; ভ্রান্তি হইতে অধর্ম জন্মে। তোমার ভ্রান্তি পর্যন্ত হইয়াছে। তুমি বিবেচনা করিয়া বল দেখি, তুমি যদি ধর্মে একের পত্নী, মনে অন্যের পত্নী হইলে, তবে তুমি দ্বিচারিণী হইলে কি না?
গৃহমধ্যে হেমচন্দ্রের অসিচর্ম ঝুলিতেছিল; মনোরমা চর্ম হস্তে লইয়া কহিল, “ভাই, হেমচন্দ্র, তোমার এ ঢাল কিসের চামড়া?”
হেমচন্দ্র হাস্য করিলেন। মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন, বালিকা!