তৃতীয় পরিচ্ছেদ : হেতু-ধূমাৎ
মনোরমা এবং হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে মৃণালিনীকে বিদায় দিয়া গিরিজায়া উপবনগৃহ প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন। যেখানে যেখানে বাতায়ন-পথ মুক্ত দেখিলেন, সেইখানে সাবধানে মুখ উন্নত করিয়া গৃহমধ্যে দৃষ্টিপাত করিলেন। এক কক্ষে হেমচন্দ্রকে শয়ানাবস্থায় দেখিতে পাইলেন; দেখিলেন, তাঁহার শয্যোপরি মনোরমা বসিয়া আছে। গিরিজায়া সেই বাতায়নতলে উপবেশন করিলেন। পূর্বরাত্রে সেই বাতায়ন-পথে যবন হেমচন্দ্রকে দেখা দিয়াছিল।
বাতায়ন-তলে উপবেশনে গিরিজায়ার অভিপ্রায় এই ছিল যে, হেমচন্দ্র মনোরমার কি কথোকথন হয়, তাহা বিরলে থাকিয়া শ্রবণ করে। কিন্তু হেমচন্দ্র নিদ্রাগত, কোন কথোকথনই ত হয় না। একাকী নীরবে সেই বাতায়ন-তলে বসিয়া গিরিজায়ার বড়ই কষ্ট হইল। কথা কহিতে পায় না, হাসিতে পায় না, ব্যঙ্গ করিতে পারে না, বড়ই কষ্ট-স্ত্রীরসনা কণ্ডূয়িত হইয়া উঠিল, মনে মনে ভাবিতে লাগিল-সেই পাপিষ্ঠ দিগ্বিজয়ই বা কোথায়? তাহাকে পাইলেও ত মুখ খুলিয়া বাঁচি। কিন্তু দিগ্বিজয় গৃহমধ্যে প্রভুর কার্যে নিযুক্ত ছিল-তাহারও সাক্ষাৎ পাইল না। তখন অন্য পাত্রাভাবে গিরিজায়া আপনার সহিত মনে মনে কথোকথন আরম্ভ করিল। সে কথোপকথন শুনিতে পাঠক মহাশয়ের কৌতূহল জন্মিয়া থাকিলে, প্রশ্নোত্তরচ্ছলে তাহা জানাইতে পারি। গিরিজায়াই প্রশ্নকর্ত্রী, গিরিজায়াই উত্তরদাত্রী।
প্র। ওলো, তুই বসিয়া কে লো?
উ। গিরিজায়া লো।
প্র। এখানে কেন লো?
উ। মৃণালিনীর জন্য লো।
প্র। মৃণালিনী তোর কে?
উ। কেউ না।
প্র। তবে তার জন্যে তোর এত মাথা ব্যথা কেন?
উ। আমার আর কাজ কি? বেড়াইয়া বেড়াইয়া কি করিব?
প্র। মৃণালিনীর জন্যে এখানে কেন?
উ। এখানে তার একটি শিকলীকাটা পাখী আছে।
প্র। পাখী ধরিয়া নিয়ে যাবি না কি?
উ। শিকলী কেটে থাকে ত ধরিয়া কি করিব? ধরিবই বা কিরূপে?
প্র। তবে বসিয়া কেন?
উ। দেখি, শিকল কেটেছে কি না।
প্র। কেটেছে না কেটেছে, জেনে কি হইবে?
উ। পাখীটির জন্যে মৃণালিনী প্রতিরাত্রে কত লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে-আজি না জানি কতই কাঁদবে। যদি ভাল সংবাদ লইয়া যাই, তবে অনেক রক্ষা হইবে।
প্র। আর যদি শিকল কেটে থাকে?
উ। মৃণালিনীকে বলিব যে, পাখী হাতছাড়া হয়েছে-রাধাকৃষ্ণ নাম শুনিবে ত আবার বনের পাখী ধরিয়া আন। পড়া পাখীর আশা ছাড়। পিঁজরা খালি রাখিও না।
প্র। মর্ ভিখারীর মেয়ে! তুই আপনার মনের মত কথা বলিলি! মৃণালিনী যদি রাগ করিয়া পিঁজরা ভাঙ্গিয়া ফেলে?
উ। ঠিক বলেছিস সই! তা সে পারে। বলা হবে না।
প্র। তবে এখানে বসিয়া রৌদ্রে পুড়িয়া মরিস কেন?
উ। বড় মাথা ধরিয়াছে, তাই। এই যে মেয়েটা ঘরের ভিতর বসিয়া আছে-এ মেয়েটা বোবা-নহিলে এখনও কথা কয় না কেন? মেয়েমানুষের মুখ এখনও বন্ধ?
ক্ষণেক পরে গিরিজায়ার মনস্কাম সিদ্ধ হইল। হেমচন্দ্রের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন মনোরমা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, ঘুম হয়েছে?”
হে। বেশ ঘুম হয়েছে।
ম। এখন বল, কি প্রকারে আঘাত পাইলে?
তখন হেমচন্দ্র রাত্রির ঘটনা সংক্ষেপে বিবৃত করিলেন। শুনিয়া মনোরমা চিন্তা করিতে লাগিল।
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার জিজ্ঞাস্য শেষ হইল। এখন আমার কথার উত্তর দাও। কালি রাত্রিতে তুমি আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া গেলে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সকল বল |”
মনোরমা মৃদু মৃদু অস্ফুটস্বরে কি বলিল, গিরিজায়া তাহা শুনিতে পাইল না। বুঝিল, চুপি চুপি কি কথা হইল।
গিরিজায়া আর কোন কথা শুনিতে না পাইয়া গাত্রোত্থান করিল। তখন পুনর্বার প্রশ্নোত্তরমালা মনোমধ্যে গ্রথিত হইতে লাগিল।
প্র। কি বুঝিলে?
উ। কয়েকটি লক্ষণ মাত্র।
প্র। কি কি লক্ষণ?
গিরিজায়া অঙ্গুলিতে গণিতে লাগিল, এক-মেয়েটি আশ্চর্য সুন্দরী; আগুনের কাছে ঘি কি গাঢ় থাকে? দুই-মনোরমা ত হেমচন্দ্রকে ভালবাসে, নহিলে এত যত্ন করিল কেন? তিন-একত্রে বাস। চারি-একত্রে রাত বেড়ান। পাঁচ-চুপি চুপি কথা।
প্র। মনোরমা ভালবাসে; হেমচন্দ্রের কি?
উ। বাতাস না থাকিলে কি জলে ঢেউ হয়? আমাকে যদি কেহ ভালবাসে, আমি তাহাকে ভালবাসিব সন্দেহ নাই।
প্র। কিন্তু মৃণালিনীও ত হেমচন্দ্রকে ভালবাসে। তবে ত হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে ভালবাসিবেই।
উ। যথার্থ। কিন্তু মৃণালিনী অনুপস্থিত, মনোরমা উপস্থিত।
এই ভাবিয়া গিরিজায়া ধীরে ধীরে গৃহের দ্বারদেশে আসিয়া দাঁড়াইল। তথায় একটি গীত আরম্ভ করিয়া কহিলেন, “ভিক্ষা দাও গো |”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : উপনয়-বহ্নিব্যাপ্যো ধূমবান্
গিরিজায়া গীত গায়িল,
“কাহে সই জীয়ত মরত কি বিধান?
ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই,
ব্রজজন টুটায়ল পরাণ |”
সঙ্গীতধ্বনি হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিল। স্বপ্নশ্রুত শব্দের ন্যায় কর্ণে প্রবেশ করিল।
গিরিজায়া আবার গায়িল,
“ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই,
ব্রজবধূ টুটায়ল পরাণ |”
হেমচন্দ্র উন্মুখ হইয়া শুনিতে লাগিলেন।
গিরিজায়া আবার গায়িল,
“মিলি সেই নাগরী, ভুলি সেই মাধব,
রূপবিহীন গোপকুঙারী।
কো জানে পিয় সই, রসময় প্রেমিক,
হেন বঁধূ রূপকি ভিখারী ||”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “এ কি! মনোরমা, এ যে গিরিজায়ার স্বর! আমি চলিলাম |” এই বলিয়া লম্ফ দিয়া হেমচন্দ্র শয্যা হইতে অবতরণ করিলেন। গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,
“আগে নাহি বুঝনু, রূপ দেখি ভুলনু,
হৃদি বৈনু চরণ যুগল।
যমুনা-সলিলে সই, তব তনু ডারব,
আন সখি ভখিব গরল ||”
হেমচন্দ্র গিরিজায়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ব্যস্ত স্বরে কহিলেন, “গিরিজায়া। এ কি গিরিজায়া! তুমি এখানে? তুমি এখানে কেন? তুমি এ দেশে কবে আসিলে?”
গিরিজায়া কহিল, “আমি এখানে অনেক দিন আসিয়াছি |” এই বলিয়া আবার গায়িতে লাগিল,
“কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,
নবীন তমালে দিব ফাঁস |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এ দেশে কেন এলে?”
গিরিজায়া কহিল, “ভিক্ষা আমার উপজীবিকা। রাজধানীতে অধিক ভিক্ষা পাইব বলিয়া আসিয়াছি-
কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,
নবীন তমালে দিব ফাঁস |”
হেমচন্দ্র গীতে কর্ণপাত না করিয়া কহিলেন, “মৃণালিনী কেমন আছে; দেখিয়া আসিয়াছ?
গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,
“নহে-শ্যাম শ্যাম শ্যাম, শ্যাম নাম জপয়ি,
ছার তনু করব বিনাশ |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার গীত রাখ। আমার কথার উত্তর দাও! মৃণালিনী কেমন আছে, দেখিয়া আসিয়াছ?”
গিরিজায়া কহিল, “মৃণালিনীকে আমি দেখিয়া আসি নাই। এ গীত আপনার ভাল না লাগে, অন্য গীত গায়িতেছি।
এ জনমের সঙ্গে কি সই জনমের সাধ ফুরাইবে।
কিবা জন্ম জন্মান্তরে, এ সাধ মোর পুরাইবে ||”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “গিরিজায়া তোমাকে মিনতি করিতেছি-গান রাখ, মৃণালিনীর সংবাদ বল |”
গি। কি বলিব?
হে। মৃণালিনীকে কেন দেখিয়া আইস নাই?
গি। গৌড়নগরে তিনি নাই।
হে। কেন? কোথায় গিয়াছেন?
গি। মথুরায়।
হে। মথুরায়? মথুরায় কাহার সঙ্গে গেলেন? কি প্রকারে গেলেন? কেন গেলেন?
গি। তাঁহার পিতা কি প্রকারে সন্ধান পাইয়া লোক পাঠাইয়া লইয়া গিয়াছেন। বুঝি তাঁহার বিবাহ উপস্থিত। বুঝি বিবাহ দিতে লইয়া গিয়াছেন।
হে। কি? কি করিতে?
গি। মৃণালিনীর বিবাহ দিতে তাঁহার পিতা তাঁহাকে লইয়া গিয়াছেন।
হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। গিরিজায়া সে মুখ দেখিতে পাইল না; আর যে হেমচন্দ্রের স্কন্ধস্থ ক্ষতমুখ ছুটিয়া বন্ধনবস্ত্র রক্তে প্লাবিত হইতেছিল, তাহাও দেখিতে পাইল না। সে পূর্বমত গায়িল,
“বিধি তোরে সাধি শুন, জন্ম যদি দিবে পুন,
আমারে আবার যেন, রমণী জনম দিবে।
লাজ ভয় তেয়াগিব এ সাধ মোর পুরাইব,
সাগর ছেঁচে রতন নিব, কণ্ঠে রাখব নিশি দিবে ||”
হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। বলিলেন, “গিরিজায়া, তোমার সংবাদ শুভ। উত্তম হইয়াছে |”
এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুন: প্রবেশ করিলেন। গিরিজায়ার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। গিরিজায়া মনে করিয়াছিল, মিছা করিয়া মৃণালিনীর বিবাহের কথা বলিয়া সে হেমচন্দ্রের পরীক্ষা করিয়া দেখিবে। মনে করিয়াছিল যে, মৃণালিনী বিবাহ উপস্থিত শুনিয়া হেমচন্দ্র বড় কাতর হইবে, বড় রাগ করিবে। কৈ, তা ত কিছুই হইল না। তখন গিরিজায়া কপালে করাঘাত করিয়া ভাবিল, “হায় কি করিলাম! কেন অনর্থক মিথ্যা কথা রটনা করিলাম। হেমচন্দ্র ত সুখী হইল দেখিতেছি – বলিয়া গেল – সংবাদ শুভ। এখন ঠাকুরাণীর দশা কি হইবে?” হেমচন্দ্র যে কেন গিরিজায়াকে বলিলেন, তোমার সংবাদ শুভ, তাহা, গিরিজায়া ভিখারিণী বৈ ত নয়-কি বুঝিবে? যে ক্রোধভরে, হেমচন্দ্র, এই মৃণালিনীর জন্য গুরুদেবের প্রতি শরসন্ধানে উদ্যত হইয়াছিলেন, সেই দুর্জয় ক্রোধ হৃদয়মধ্যে সমুদিত হইল। অভিমানাধিক্যে দুর্দম ক্রোধাবেগে, হেমচন্দ্র গিরিজায়াকে বলিলেন, “তোমার সংবাদ শুভ!”
গিরিজায়া তাহা বুঝিতে পারিল না। মনে করিল, এই ষষ্ঠ লক্ষণ। কেহ তাহাকে ভিক্ষা দিল না; সেও ভিক্ষার প্রতীক্ষা করিল না। “শিকলী কাটিয়াছে” সিদ্ধান্ত করিয়া গৃহাভিমুখে চলিল।