যে কুটীরের নিকটস্থ বৃক্ষতলে বসিয়া হেমচন্দ্র বিশ্রাম করিতেছিলেন, সেই কুটীরমধ্যে এক পাটনী বাস করিত। কুটীরমধ্যে তিনটি ঘর। এক ঘরে পাটনীর পাকাদি সমাপন হইত। অপর ঘরে পাটনীর পত্নী শিশুসন্তান সকল লইয়া শয়ন করিত। তৃতীয় ঘরে পাটনীর যুবতী কন্যা রত্নময়ী আর অপর দুইটি স্ত্রীলোক শয়ন করিয়াছিল। সেই দুইটি স্ত্রীলোক পাঠক মহাশয়ের নিকট পরিচিতা; মৃণালিনী আর গিরিজায়া নবদ্বীপে অন্যত্র আশ্রয় না পাইয়া এই স্থানে আশ্রয় লইয়াছিলেন।
একে একে তিনটি স্ত্রীলোক প্রভাতে জাগরিতা হইল। প্রথমে রত্নময়ী জাগিল। গিরিজায়াকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “সই?”
গি। কি সই?
র। তুমি কোথায় সই?
গি। বিছানাসই।
র। উঠ না সই!
গি। না সই।
র। গায়ে জল দিব সই।
গি। জলসই? ভাল সই, তাও সই।
র। নহিলে ছাড়ি কই।
গি। ছাড়িবে কেন সই? তুমি আমার প্রাণের সই-তোমার মত আছে কই? তুমি পারঘাটার রসমই-তোমায় না কইলে আর কারে কই?
র। কথায় সই তুমি চিরজই: আমি তোমার কাছে বোবা হই, আর মিলাইতে পারি কই?
গি। আরও মিল চাই?
র। তোমার মুখে ছাই, আর মিলে কাজ নাই, আমি কাজে যাই।
এই বলিয়া রত্নময়ী গৃহকর্মে গেল। মৃণালিনী এ পর্যন্ত কোন কথা কহেন নাই। এখন গিরিজায়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “ঠাকুরাণি, জাগিয়াছ?”
মৃণালিনী কহিলেন, “জাগিয়াই আছি। জাগিয়াই থাকি |”
গি। কি ভাবিতেছিলে?
মৃ। যাহা ভাবি।
গিরিজায়া তখন গম্ভীরভাবে কহিল, “কি করিব? আমার দোষ নাই। আমি শুনিয়াছি, তিনি এই নগরমধ্যে আছেন; এ পর্যন্ত সন্ধান পাই নাই। কিন্তু আমরা ত সবে দুই তিন দিন আসিয়াছি। শীঘ্র সন্ধান করিব |”
মৃ। গিরিজায়া, যদি এ নগরে সন্ধান না পাই? তবে যে এই পাটনীর গৃহে মৃত্যু পর্যন্ত বাস করিতে হইবে। আমার যে যাইবার স্থান নাই।
মৃণালিনী উপাধানে মুখ লুকাইলেন। গিরিজায়ারও গণ্ডে নীরবস্রুত অশ্রু বহিতে লাগিল।
এমন সময় রত্নময়ী শশব্যস্তে গৃহমধ্যে আসিয়া কহিল, “সই! সই! দেখিয়া যাও। আমাদিগের বটতলায় কে ঘুমাইতেছে। আশ্চর্য পুরুষ!”
গিরিজায়া কুটীরদ্বারে দেখিতে আসিল। মৃণালিনীও কুটীরদ্বার পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন। উভয়েই দৃষ্টিমাত্র চিনিল।
সাগর একেবারে উছলিয়া উঠিল। মৃণালিনী গিরিজায়াকে আলিঙ্গন করিলেন। গিরিজায়া গায়িল,
“কণ্টকে গঠিল বিধি মৃণাল অধমে |”
সেই ধ্বনি স্বপ্নবৎ হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল। মৃণালিনী গিরিজায়ার কণ্ঠকণ্ডূয়ন দেখিয়া কহিলেন, “চুপ, রাক্ষসী আমাদিগের দেখা দেওয়া হইবে না, ঐ উনি জাগরিত হইতেছেন। এই অন্তরাল হইতে দেখ, উনি কি করেন। উনি যেখানে যান, অদৃশ্যভাবে দূরে থাকিয়া উঁহার সঙ্গে যাও- এ কি! উঁহার অঙ্গ রক্তময় দেখিতেছি কেন? চল, তবে আমিও সঙ্গে চলিলাম |”
হেমচন্দ্রের ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। প্রাত:কাল উপস্থিত দেখিয়া তিনি শূলদণ্ডে ভর করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন, এবং ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে চলিলেন।
হেমচন্দ্র কিয়দ্দূর গেলে, মৃণালিনী আর গিরিজায়া তাঁহার অনুসরণার্থ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তখন রত্নময়ী জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরাণি, উনি তোমার কে?”
মৃণালিনী কহিলেন, “দেবতা জানেন |”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : প্রতিজ্ঞা-পর্বতো বহ্নিমান
বিশ্রাম করিয়া হেমচন্দ্র কিঞ্চিৎ সবল হইয়াছিলেন। শোণিতস্রাবও কতক মন্দীভূত হইয়াছিল। শূলে ভর করিয়া হেমচন্দ্র স্বচ্ছন্দে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন।
গৃহে আসিয়া দেখিলেন, মনোরমা দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া আছেন।
মৃণালিনী ও গিরিজায়া অন্তরালে থাকিয়া মনোরমাকে দেখিলেন।
মনোরমা চিত্রার্পিত পুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। দেখিয়া মৃণালিনী মনে মনে ভাবিলেন, “আমার প্রভু যদি রূপে বশীভূত হয়েন, তবে আমার সুখের নিশি প্রভাত হইয়াছে |” গিরিজায়া ভাবিল, “রাজপুত্র যদি রূপে মুগ্ধ হয়েন, তবে আমার ঠাকুরাণীর কপাল ভাঙ্গিয়াছে |”
হেমচন্দ্র মনোরমার নিকট আসিয়া কহিলেন, “মনোরমা-এমন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছ কেন?”
মনোরমা কোন কথা কহিলেন না। হেমচন্দ্র পুনরপি ডাকিলেন, “মনোরমা!”
তথাপি উত্তর নাই; হেমচন্দ্র দেখিলেন, আকাশমার্গে তাঁহার স্থিরদৃষ্টি স্থাপিত হইয়াছে।
হেমচন্দ্র পুনরায় বলিলেন, “মনোরমা, কি হইয়াছে?”
তখন মনোরমা ধীরে ধীরে আকাশ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া হেমচন্দ্রের মুখমণ্ডলে স্থাপিত করিল। এবং কিয়ৎকাল অনিমেষলোচনে তৎপ্রতি চাহিয়া রহিল। পরে হেমচন্দ্রের রুধিরাক্ত পরিচ্ছদে দৃষ্টিপাত হইল। তখন মনোরমা বিস্মিত হইয়া কহিল, “এ কি হেমচন্দ্র! রক্ত কেন? তোমার মুখ শুষ্ক; তুমি কি আহত হইয়াছ?”
হেমচন্দ্র অঙ্গুলি দ্বারা স্কন্ধের ক্ষত দেখাইয়া দিলেন।
মনোরমা তখন হেমচন্দ্রের হস্ত ধারণ করিয়া গৃহমধ্যে পালঙ্কোপরি লইয়া গেল। এবং পলকমধ্যে বারিপূর্ণ ভৃঙ্গার আনীত করিয়া, একে একে হেমচন্দ্রের গাত্রবসন পরিত্যক্ত করাইয়া অঙ্গের রুধির সকল ধৌত করিল। এবং গোজাতিপ্রলোভন নবদুর্বাদল ভূমি হইতে ছিন্ন করিয়া আপন কুন্দনিন্দিত দন্তে চর্বিত করিল। পরে তাহা ক্ষতমুখে প্রয়োগ করিয়া উপবীতাকারে বস্ত্র দ্বারা বাঁধিল। তখন কহিল, “হেমচন্দ্র! আর কি করিব? তুমি সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়াছ, নিদ্রা যাইবে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “নিদ্রাভাবে নিতান্ত কাতর হইতেছি |”
মৃণালিনী মনোরমার কার্য দেখিয়া চিন্তিতান্ত:করণে গিরিজায়াকে কহিলেন, “এ কে গিরিজায়া?”
গি। নাম শুনিলাম মনোরমা।
মৃ। এ কি হেমচন্দ্রের মনোরমা?
গি। তুমি কি বিবেচনা করিতেছ?
মৃ। আমি ভাবিতেছি, মনোরমাই ভাগ্যবতী। আমি হেমচন্দ্রের সেবা করিতে পারিলাম না, সে করিল। যে কার্যের জন্য আমার অন্ত:করণ দগ্ধ হইতেছিল-মনোরমা সে কার্য সম্পন্ন করিল-দেবতারা উহাকে আয়ুষ্মতী করুন। গিরিজায়া, আমি গৃহে চলিলাম, আমার আর থাকা উচিত নহে। তুমি এই পল্লীতে থাক, হেমচন্দ্র কেমন থাকেন, সংবাদ লইয়া যাইও। মনোরমা যেই হউক, হেমচন্দ্র আমারই।