কৃষ্ণ। তাই ত! তবে কি মনে করিয়া? আফিঙ্গ চাই না ত?
রো। যে সামগ্রী প্রাণ ধর্যে দিতে পারবে না, তার জন্যে কি আমি এসেছি! আমাকে কাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাই এসেছি।
কৃ। এই এই। তবে আফিঙ্গের জন্য!
রো। না, ঠাকুরদাদা না। তোমার দিব্য, আফিঙ্গ চাই না। কাকা বললেন যে, যে উইল আজ লেখাপড়া আছে, তাতে তোমার দস্তখত হয় নাই।
কৃ। সে কি! আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমি দস্তখত করিয়াছি।
রো। না, কাকা কহিলেন যে, তাঁহার যেন স্মরণ হচ্ছে, তুমি তাতে দস্তখত কর নাই; ভাল সন্দেহ রাখায় দরকার কি? তুমি কেন সেখানা খুলে একবার দেখ না।
কৃ। বটে–তবে আলোটা ধর দেখি।
বলিয়া কৃষ্ণকান্ত উঠিয়া উপাধানের নিম্ন হইতে চাবি লইলেন। রোহিণী নিকটস্থ দীপ হস্তে লইল। কৃষ্ণকান্ত প্রথমে একটি ক্ষুদ্র হাতবাক্স খুলিয়া একটি বিচিত্র চাবি লইয়া, পরে একটা
চেষ্টড্রয়ারের একটি দেরাজ খুলিলেন এবং অনুসন্ধান করিয়া ঐ উইল বাহির করিলেন।পরে বাক্স হইতে চশমা বাহির করিয়া নাসিকার উপর সংস্হাপনের উদ্যোগ দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু চশমা লাগাইতে লাগাইতে দুই চারি বার আফিঙ্গের ঝিমকিনি আসিল–সুতরাং তাহাতে কিছুকাল বিলম্ব হইল। পরিশেষে চশমা সুস্থির হইলে কৃষ্ণকান্ত উইলে নেত্রপাত করিয়া দেখিয়া হাস্য করিয়া বলিলেন, “রোহিণিী আমি কি বুড় হইয়া বিহ্বল হইয়াছি? এই দেখ, আমার দস্তখত |
রোহিণী বলিল, “বালাই, বুড়ো হবে কেন? আমাদের কেবল জোর করিয়া নাতিনী বল বই ত না। তা ভাল, আমি এখন যাই, কাকাকে বলি গিয়া |”
রোহিণী তখন কৃষ্ণকান্তের শয়নমন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল।
গভীর নিশাতে কৃষ্ণকান্ত নিদ্রা যাইতেছিলেন, অকস্মাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলেন যে, তাঁহার শয়নগৃহে দীপ জ্বলিতেছে না। সচরাচর সমস্ত রাত্রি দীপ জ্বলিত, কিন্তু সে রাত্রে দীপ নির্বণ হইয়াছে দেখিলেন, নিদ্রাভঙ্গকালে এমতও শব্দ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল যে, যেন কে একটা চাবি কলে ফিরাইল। এমত বোধ হইল, যেন ঘরে কে মানুষ বেড়াইতেছে। মানুষ তাঁর পর্যঙ্কের শিরোদেশ পর্যন্ত আসিল–তাঁহার বালিশে হাত দিল। কৃষ্ণকান্ত আফিঙ্গের নেশায় বিভোর; না নিদ্রিত, না জাগরিত, বড় কিছু হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না। ঘরে যে আলো নাই–তাহাও ঠিক বুঝেন নাই, কখন অর্ধনিদ্রিত–কখন অর্ধসচেতন–সচেতনও চক্ষু খুলে না। একবার দৈবাৎ চক্ষু খুলিবায় কতকটা অন্ধকার বোধ হইল বটে, কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখন মনে করিতেছিলেন যে, তিনি হরি ঘোষের মোকদ্দামায় জাল দলিল দাখিল করায়, জেলখানায় গিয়াছেন।জেলখানা ঘোরান্ধকার। কিছু পরে হঠাৎ যেন চাবি খোলার শব্দ অল্প কানে গেল–এ কি জেলের চাবি পড়িল? হঠাৎ একটু চমক হইল। কৃষ্ণকান্ত সটকা হাতড়াইলেন, পাইলেন না–অভ্যাসবশতঃ ডাকিলেন, “হরি!”
কৃষ্ণকান্ত অন্তঃপুরে শয়ন করিতেন না–বহির্বাটীতেও শয়ন করিতেন না। উভয়ের মধ্যে একটি ঘর ছিল। সেই ঘরে শয়ন করিতেন। সেখানে হরি নামক একজন খানসামা তাঁহার প্রহরী স্বরূপ শয়ন করিত। আর কেহ না। কৃষ্ণকান্ত তাহাকেই ডাকিলেন, “হরি!”
কৃষ্ণকান্ত বারেক মাত্র হরিকে ডাকিয়া, আবার আফিমে ভোর হইয়া ঝিমাইতে লাগিলেন। আসল উইল, তাঁহার গৃহ হইতে সেই অবসরে অন্তর্হিত হইল। জাল উইল তৎপরিবর্তে স্থাপিত হইল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতে রোহিণী আবার রাঁধিতে বসিয়াছে, আবার সেখানে হরলাল উঁকি মারিতেছে। ভাগ্যশঃ ব্রহ্মানন্দ বাড়ী ছিল না–নহিলে কি একটা মনে করিতে পারিত।
হরলাল ধীরে ধীরে রোহিণীর কাছে গেল–রোহিণী বড় চাহিয়া দেখে না। হরলাল বলিল, “চাহিয়া দেখ, হাঁড়ি ফাটিবে না |”
রোহিণী চাহিয়া দেখিয়া হাসিল। হরলাল বলিল, “কি করিয়াছ?”
রোহিণী অপহৃত উইল আনিয়া হরলালকে দেখিতে দিল। হরলাল পড়িয়া দেখিল–আসল উইল বটে। তখন সে দুষ্টের মুখে হাসি ধরে না। উইল হাতে করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি প্রকারে আনিলে?”
রোহিণী সে গল্প আরম্ভ করিল। প্রকৃত কিছুই বলিল না। একটি মিথ্যা উপন্যাস বলিতে লাগিল–বলিতে বলিতে সে হরলালের হাত হইতে উইলখানি লইয়া দেখাইল, কি প্রকারে কাগজখানা একটা কলমদানের ভিতর পড়িয়া ছিল। উইল চুরির কথা শেষ হইলে রোহিণী হঠাৎ উইলখানা হাতে করিয়া উঠিয়া গেল। যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার হাতে উইল নাই দেখিয়া হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “উইল কোথায় রাখিয়া আসিলে?”
রো। তুলিয়া রাখিয়া আসিয়াছি।
হ। আর তুলিয়া রাখিয়া কি হইবে? আমি এখনই যাইব।
রো। এখনই যাবে? এত তাড়াতাড়ি কেন?
হ। আমার থাকিবার যো নাই।
রো। তা যাও।
হ। উইল?
রো। আমার কাছে থাক।
হ। সে কি? উইল আমায় দিবে না?
রো। তোমার কাছে থাকাও যে, আমার কাছে থাকাও সে।
হ। যদি আমাকে উইল দিবে না, তবে ইহা চুরি করিলে কেন?
রো। আপনারই জন্য। আপনারই জন্য ইহা রহিল। যখন আপনি বিধবাবিবাহ করিবেন, আপনার স্ত্রীকে এ উইল দিব। আপনি লইয়া ছিঁড়িয়া ফেলিবেন।
হরলাল বুঝিল, বলিল, “তা হবে না–রোহিণী! টাকা যাহা চাও, দিব |”
রো। লক্ষ টাকা দিলেও নয়। যাহা দিবে বলিয়াছিলে, তাই চাই।
হ। তা হয় না। আমি জাল করি, চুরি করি, আপনারই হকের জন্য। তুমি চুরি করিয়াছ, কার হকের জন্য?
রোহিণীর মুখ শুকাইল। রোহিণী অধোবদনে রহিল। হরলাল বলিতে লাগিল, “আমি যাই হই–কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র। যে চুরি করিয়াছে, তাহাকে কখনও গৃহিণী করিতে পারিব না |”