যামিনী কাঁদিল, কিন্তু ভ্রমর আর ঔষধ খাইল না। ঔষধ খায় না, রোগের শান্তি নাই–কিন্তু ভ্রমর দিন দিন প্রফুল্লচিত্ত হইতে লাগিল।
এত দিনের পর ভ্রমর আবার হাসি তামাসা আরম্ভ করিল–ছয় বৎসরের পর এই প্রথম হাসি তামাসা। নিবিবার আগে প্রদীপ হাসিল।
যতদিন যাইতে লাগিল–অন্তিম কাল দিনে দিনে যত নিকট হইতে লাগিল–ভ্রমর তত স্থির, প্রফুল্ল হাস্যমূর্তি। শেষে সেই ভয়ঙ্কর শেষ দিন উপস্থিত হইল। ভ্রমর পৌরজনের চাঞ্চল্য এবং যামিনীর কান্না দেখিয়া বুঝিলেন, আজ বুঝি দিন ফুরাইল। শরীরের যন্ত্রণাও সেইরূপ অনুভূত করিলেন। তখন ভ্রমর যামিনীকে বলিলেন,“আজ শেষ দিন|”
যামিনী কাঁদিল। ভ্রমর বলিল, “দিদি–আজ শেষ দিন–আমার কিছু ভিক্ষা আছে–কথা রাখিও|”
যামিনী কাঁদিতে লাগিল–কথা কহিল না।
ভ্রমর বলিল, “আমার এক ভিক্ষা; আজ কাঁদিও না।-আমি মরিলে পর কাঁদিও –আমি বারণ করিতে আসিব না–কিন্তু আজ তোমাদের সঙ্গে কথা কইতে পারি, নির্বিঘ্নে কহিয়া মরিব, সাধ করিতেছে|”
যামিনী চক্ষের জল মুছিয়া কাছে বসিল–কিন্তু অবরুদ্ধ বাষ্পে আর কথা কহিতে পারিল না।
ভ্রমর বলিতে লাগিল, “আর একটা ভিক্ষা–তুমি ছাড়া আর কেহ এখানে না আসে। সময়ে সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিব–কিন্তু এখন আর কেহ না আসে। তোমার সঙ্গে আর কথা কহিতে পাব না|”
যামিনী আর কতক্ষণ কান্না রাখিবে?
ক্রমে রাত্রি হইতে লাগিল। ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, রাত্রি কি জ্যোৎস্না?”
যামিনী জানেলা খুলিয়া দেখিয়া বলিল, “দিব্য জ্যোৎস্না উঠিয়াছে|”
ভ্র। তবে জানেলাগুলি সব খুলিয়া দাও–আমি জ্যোৎস্না দেখিয়া মরি। দেখ দেখি, ঐ জানেলার নীচে যে ফুলবাগান, উহাতে ফুল ফুটিয়াছে কি না?
সেই জানেলায় দাঁড়াইয়া প্রভাতকালে ভ্রমর, গোবিন্দলালের সঙ্গে কথোপকথন করিতেন। আজি সাত বৎসর ভ্রমর সে জানেলার দিকে যান নাই–সে জানেলা খোলেন নাই।
যামিনী কষ্টে সেই জানেলা খুলিয়া বলিল, “কই, এখানে ত ফুলবাগান নাই–এখানে কেবল খড়বন–আর দুই-একটা মরা মরা গাছ আছে–তাতে ফুল পাতা নাই|”
ভ্রমর বলিল, “সাত বৎসর হইল, ওখানে ফুলবাগান ছিল। বে-মেরামতে গিয়াছে। আমি সাত বৎসর দেখি নাই |”
অনেক্ষণ ভ্রমর নীরব হইয়া রহিলেন। তার পর ভ্রমর বলিলেন, “যেখানে হইতে পার দিদি, আজ আমার ফুল আনাইয়া দিতে হইবে। দেখিতেছ না, আজি আবার আমার ফুলশয্যা?”
যামিনী আজ্ঞা পাইয়া দাস দাসী রাশীকৃত ফুল আনিয়া দিল। ভ্রমর বলিল, “ফুল আমার বিছানায় ছড়াইয়া দাও–আজ আমার ফুলশয্যা |”
যামিনী তাহাই করিল। তখন ভ্রমরের চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। যামিনী বলিল, “কাঁদিতেছ কেন দিদি?”
ভ্রমর বলিল, “দিদি, একটি বড় দুঃখ রহিল। যে দিন তিনি আমায় ত্যাগ করিয়া কাশী যান, সেই দিন যোড়হাতে কাঁদিতে কাঁদিতে দেবতার কাছে ভিক্ষা চাহিয়াছিলাম, এক দিন যেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। স্পর্ধা করিয়া বলিয়াছিলাম, আমি যদি সতী হই, তবে আবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে। কই, আর ত দেখা হইল না। আজিকার দিন–মরিবার দিনে, দিদি, যদি একবার দেখিতে পাইতাম! এক দিনে, দিদি, সাত বৎসরের দুঃখ ভুলিতাম!”
যামিনী বলিল, “দেখিবে?” ভ্রমর যেন বিদুৎ চমকিয়া উঠিল–বলিল, “কার কথা বলিতেছ?”
যামিনী স্থিরভাবে বলিল, “গোবিন্দলালের কথা। তিনি এখানে আছেন–বাবা তোমার পীড়ার সংবাদ তাঁহাকে দিয়াছিলেন। শুনিয়া তোমাকে একবার দেখিবার জন্য তিনি আসিয়াছেন। আজ পৌঁছিয়াছেন। তোমার অবস্থা দেখিয়া ভয়ে এতক্ষণ তোমাকে বলিতে পারি নাই–তিনিও সাহস করিয়া আসিতে পারেন নাই|”
ভ্রমর কাঁদিয়া বলিল, “একবার দেখা দিদি! ইহজন্মে আর একবার দেখি! এই সময়ের আর একবার দেখা!”
যামিনী উঠিয়া গেল। অল্পক্ষণ পরে, নিঃশব্দপাদবিক্ষেপে গোবিন্দলাল–সাত বৎসরের পর নিজ শয্যাগৃহে প্রবেশ করিলেন।
দুজনেই কাঁদিতেছিল। এক জনও কথা কহিতে পারিল না।
ভ্রমর, স্বামীকে কাছে আসিয়া বিছানায় বসিতে ইঙ্গিত করিল।-গোবিন্দলাল কাঁদিতে কাঁদিতে বিছানায় বসিল। ভ্রমর তাঁহাকে আরও কাছে আসিতে বলিল,-গোবিন্দলাল আরও কাছে আসিল। তখন ভ্রমর আপন করতলের নিকট স্বামীর চরণ পাইয়া, সেই চরণযুগল স্পর্শ করিয়া পদরেণু লইয়া মাথায় দিল। বলিল, “আজ আমার সকল অপরাধ মার্জনা করিয়া, আশীর্বাদ করিও জন্মান্তরে যেন সুখী হই |”
গোবিন্দলাল কোন কথা কহিতে পারিলেন না। ভ্রমরের হাত, আপন হাতে তুলিয়া লইলেন। সেইরূপ হাতে হাত রহিল। অনেক্ষণ রহিল। ভ্রমর নিঃশব্ধে প্রাণত্যাগ করিল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
ভ্রমর মরিয়া গেল। যথারীতি তাহার সৎকার হইল। সৎকার করিয়া আসিয়া গোবিন্দলাল গৃহে বসিলেন। গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া অবধি, তিনি কাহারও সহিত কথা কহেন নাই।
আবার রজনী পোহাইল। ভ্রমরের মৃত্যুর পরদিন, যেমন সূর্য প্রত্যহ উঠিয়া থাকে, তেমনি উঠিল। গাছের পাতা ছায়ালোকে উজ্জ্বল হইল।–সরোবরের কৃষ্ণবারি ক্ষুদ্র বীচি বিক্ষেপ করিয়া জ্বলিতে লাগিল; আকাশের কালো মেঘ সাদা হইল–ভ্রমর যেন মরে নাই। গোবিন্দলাল বাহির হইলেন।
গোবিন্দলাল দুই জন স্ত্রীলোককে ভাল বাসিয়াছিলেন–ভ্রমরকে আর রোহিণীকে। রোহিণী মরিল–ভ্রমর মরিল। রোহিণীর রূপে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন–যৌবনের অতৃপ্ত রূপতৃষ্ণা শান্ত করিতে পারেন নাই। ভ্রমরকে ত্যাগ করিয়া রোহিণীকে গ্রহণ করিলেন। রোহিণীকে গ্রহণ করিয়াই জানিয়াছিলেন যে, এ রোহিণী, ভ্রমর নহে–এ রূপতৃষ্ণা, এ স্নেহ নহে–এ ভোগ এ সুখ নহে–এ মন্দারঘর্ষণপীড়িতবাসুকিনিশ্বাসনির্গত হলাহল, এ ধন্বন্তরিভাণ্ডনিঃসৃত সুধা নহে। বুঝিতে পারিলেন যে, এ হৃদয়সাগর, মন্থনের উপর মন্থন করিয়া যে হলাহল তুলিয়াছি, তাহা অপরিহার্য্য, অবশ্য পান করিতে হইবে–নীলকণ্ঠের ন্যায় গোবিন্দলাল সে বিষ পান করিলেন। নীলকণ্ঠের কণ্ঠস্থ বিষের মত, সে বিষ তাঁহার কণ্ঠে লাগিয়া রহিল। সে বিষ জীর্ণ হইবার নহে–সে বিষ উদ্গীর্ণ করিবার নহে। কিন্তু তখন সেই পূর্বপরিজ্ঞাতস্বাদ বিশুদ্ধ ভ্রমরপ্রণয়সুধা–স্বর্গীয় গন্ধযুক্ত, চিত্তপুষ্টিকর, সর্বরোগের ঔষধস্বরূপ, দিবারাত্রি স্মৃতিপথে জাগিতে লাগিল। যখন প্রসাদপুরে গোবিন্দলাল রোহিণীর সঙ্গীতস্রোতে ভাসমান, তখনই ভ্রমর তাঁহার চিত্তে প্রবলপ্রতাপযুক্তা অধীশ্বরী–ভ্রমর অন্তরে, রোহিণী বাহিরে। তাই রোহিণী অত শীঘ্র মরিল। যদি কেহ সে কথা না বুঝিয়া থাকেন, তবে বৃথায় এ আখ্যায়িকা লিখিলাম।