হরলাল বলিল, “কাল এসেছি। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে |”
রোহিণী শিহরিল; বলিল, “আজি এখানে খাবেন? সরু চালের ভাত চড়াব কি?”
হ। চড়াও চড়াও। কিন্তু সে কথা নয়। তোমার এক দিনের কথা মনে পড়ে কি?
রোহিণী চুপ করিয়া মাটি পানে চাহিয়া রহিল। হরলাল বলিল, “সেই দিন যে দিন তুমি গঙ্গাস্নান করিয়া আসিতে, যাত্রীদিগের দলছাড়া হইয়া পিছাইয়া পড়িয়াছিলে? মনে পড়ে?”
রো। (বাঁ হাতের চারিটি আঙ্গুল দাইন হাতে ধরিয়া অধোবদনে) মনে পড়ে।
হ। যে দিন তুমি পথ হারাইয়া মাঠে পড়িয়াছিলে, মনে পড়ে?
রো। পড়ে।
হ। যে দিন মাঠে তোমার রাত্রি হইল, তুমি একা; জনকত বদমাস তোমার সঙ্গ নিল– মনে পড়ে?
রো। পড়ে।
হ। সে দিন কে তোমায় রক্ষা করিয়াছিল?
রো। তুমি। তুমি ঘোড়ার উপরে সেই মাঠ দিয়া কোথায় যাইতেছিলে–
হ। শালীর বাড়ী।
রো। তুমি দেখিতে পাইয়া আমায় রক্ষা করিলে–আমায় পাল্কী বেহারা করিয়া বাড়ী পাঠাইয়া দিলে। মনে পড়ে বই কি। সে ঋণ আমি কখনও পরিশোধ করিতে পারিব না।
হ। আজ সে ঋণ পরিশোধ করিতে পার–তার উপর আমায় জন্মের মত কিনিয়া রাখিতে পার, করিবে?
রো। কি বলুন–আমি প্রাণ দিয়াও আপনার উপকার করিব।
হ। কর না কর, এ কথা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিও না।
রো। প্রাণ থাকিতে নয়।
হ। দিব্য কর।
রোহিণী দিব্য করিল।
তখন হরলাল কৃষ্ণকান্তের উইল ও জাল উইলের কথা বুঝাইয়া বলিল। শেষে বলিল, “সেই আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল তাহার বদলে রাখিয়া আসিতে হইবে। আমাদের বাড়ীতে তোমার যাতায়াত আছে। তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি অনায়াসে পার। আমার জন্য ইহা করিবে?”
রোহিণী শিহরিল। বলিল, “চুরি! আমাকে কাটিয়া ফেলিলেও আমি পারিব না |”
হ। স্ত্রীলোক এমন অসারই বটে–কথার রাশি মাত্র। এই বুঝি এ জন্মে তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবে না!
রো। আর যা বলুন, সব পারিব। মরিতে বলেন, মরিব। কিন্তু এ বিশ্বাসঘাতকের কাজ পারিব না।
হরলাল কিছুতেই রোহিণীকে সম্মত করিতে না পারিয়া, সেই হাজার টাকার নোট রোহিণীর হাতে দিতে গেল। বলিল, “এই হাজার টাকা পুরস্কার আগাম নাও। এ কাজ তোমার করিতে হইবে|”
রোহিণী নোট লইল না। বলিল, “টাকার প্রত্যাশা করি না। কর্তার সমস্ত বিষয় দিলেও পারিব না। করিবার হইত ত আপনার কথাতেই করিতাম | ”
হরলাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, বলিল, “মনে করিয়াছিলাম, রোহিণী, তুমি আমার হিতৈষী। পর কখনও আপন হয়? দেখ, আজ যদি আমার স্ত্রী থাকিত, আমি তোমার খোশামোদ করিতাম না। সেই আমার এ কাজ করিত |”
এবার রোহিণী একটু হাসিল। হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিলে যে?”
রো। আপনার স্ত্রীর নামে সেই বিধবাবিবাহের কথা মনে পড়িল। আপনি না কি বিধবাবিবাহ করিবেন?
হ। ইচ্ছা ত আছে–কিন্তু মনের মত বিধবা পাই কই?
রো। তা বিধবাই হৌক, সধবাই হৌক–বলি বিধবাই হৌক, কুমারীই হৌক–একটা বিবাহ করিয়া সংসারী হইলেই ভাল হয়। আমরা আত্মীয়স্বজন সকলেরই তাহলে আহ্লাদ হয়।
হ। দেখ, রোহিণী, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত।
রো। তা ত এখন লোকে বলিতেছে।
হ। দেখ, তুমিও একটি বিবাহ করিতে পার— কেন করিবে না?
রোহিণী মাথার কাপড় একটু টানিয়া মুখ ফিরাইল। হরলাল বলিতে লাগিল,–“দেখ তোমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রাম সুবাদ মাত্র–সম্পর্কে বাধে না |”
এবার রোহিণী লম্বা করিয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া, উনুন গোড়ায় বসিয়া যান, দালে কাটি দিতে আরম্ভ করিল। দেখিযা বিষণ্ণ হইয়া হরলাল ফিরিয়া চলিল।
হরলাল দ্বার পর্যন্ত গেলে, রোহিণী বলিল, “কাগজখানা না হয় রাখিয়া যান, দেখি, কি করিতে পারি |”
হরলাল আহ্লাদিত হইয়া জাল উইল ও নোট রোহিণীর নিকটে রাখিল। দেখিয়া রোহিণী বলিল, “নোট না। শুধু উইলখানা রাখুন |”
হরলাল তখন জাল উইল রাখিয়া নোট লইয়া গেল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ঐ দিবস রাত্রি আটটার সময়ে কৃষ্ণকান্ত রায় আপন শয়নমন্দিরে পর্যঙ্কে বসিয়া উপাধানে পৃষ্ঠ রক্ষা করিয়া, সটকায় তামাক টানিতেছিলেন এবং সংসারে একমাত্র ঔষধ–মাদকমধ্যে শ্রেষ্ঠ–অহিফেন ওরফে আফিমের নেশায় মিঠে রকম ঝিমাইতেছিলেন। যেন হরলাল তিন টাকা তের আনা দু কড়া দু ক্রান্তি মূল্যে তাঁহার সমুদয় সম্পত্তি কিনিয়া লইয়াছে। আবার যেন কে বলিয়া দিল যে, না, এ দানপত্র নহে, এ তমসুক। তখনই যেন দেখলেন যে, ব্রহ্মার বেটা বিষ্ণু আসিয়া বৃষভারূঢ় মহাদেবের কাছে এক কৌটা আফিম কর্জ লইয়া, এই দলিল লিখিয়া দিয়া, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বন্ধক রাখিয়াছেন–মহাদেব গাঁজার ঝোঁকে ফোরক্লোজ করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। এমত সময়ে, রোহিণী ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা কি ঘুমাইয়াছ?”
কৃষ্ণকান্ত ঝিমাইতে ঝিমাইতে কহিলেন, “কে নন্দী? ঠাকুরকে এই বেলা ফোরক্লোজ করিতে বল |”
রোহিণী বুঝিল যে, কৃষ্ণকান্তের আফিমের আমল হইয়াছে। হাসিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা, নন্দী কে?”
কৃষ্ণকান্ত ঘাড় না তুলিয়া বলিলেন, “হুম্ ঠিক বলেছ। বৃন্দাবনে গোয়ালাবাড়ী মাখন খেয়েছে–আজও তার কড়ি দেয় নাই|”
রোহিণী খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। তখন কৃষ্ণকান্তের চমক হইল, মাথা তুলিয়া দেখিয়া বলিলেন, “কে ও, অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা রোহিণী?”
রোহিণী উত্তর করিল, “মৃগশিরা আর্দ্রা পুনর্বসু পুষ্যা |”
কৃষ্ণ। অশ্লেষা মঘা পূর্বফাল্গুনী।
রো। ঠাকুরদাদা, আমি কি তোমার কাছে জ্যোতিষ শিখতে এয়েছি!