সেই সময়ে যদি গোবিন্দলাল দুই পা ফিরিয়া গিয়া, ভ্রমরের রুদ্ধ দ্বার ঠেলিয়া একবার বলিতেন–“ভ্রমর, আমি আবার আসিতেছি,” তবে সকল মিটিত। গোবিন্দলালের অনেক বার সে ইচ্ছা হইয়াছিল। ইচ্ছা হইলেও তাহা করিলেন না। ইচ্ছা হইলেও একটু লজ্জা করিল। ভাবিলেন, এত তাড়াতাড়ি কি? যখন মনে করিব, তখন ফিরিব। ভ্রমরের কাছে গোবিন্দলাল অপরাধী। আবার ভ্রমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে সাহস হইল না। যাহা হয় একটা স্থির করিবার বুদ্ধি হইল না। যে পথে যাইতেছেন, সেই পথে চলিলেন। তিনি চিন্তাকে বর্জন করিয়া–বহির্বটীতে আসিয়া সজ্জিত অশ্বে আরোহণপূর্বক কশাঘাত করিলেন। পথে যাইতে যাইতে রোহিণীর রূপরাশি হৃদয়মধ্যে ফুটিয়া উঠিল।
কৃষ্ণকান্তের উইল – ২য় খণ্ড – ০১-০৫
দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : প্রথম বৎসর
হরিদ্রাগ্রামের বাড়ীতে সংবাদ আসিল, গোবিন্দলাল, মাতা প্রভৃতি সঙ্গে নির্বিঘ্নে সুস্থ শরীরে কাশীধামে পৌঁছিয়াছেন। ভ্রমরের কাছে কোন পত্র আসিল না। অভিমানে ভ্রমরও পত্র লিখিল না। পত্রাদি আমলাবর্গের কাছে আসিতে লাগিল।
এক মাস গেল, দুই মাস গেল। পত্রাদি আসিতে লাগিল। শেষ একদিন সংবাদ আসিল যে, গোবিন্দলাল কাশী হইতে বাটী যাত্রা করিয়াছেন।
ভ্রমর শুনিয়া বুঝিল যে, গোবিন্দলাল কেবল মাকে ভুলাইয়া, অন্যত্র গমন করিয়াছেন। বাড়ী আসিবেন এমন ভরসা হইল না।
এই সময়ে ভ্রমর গোপনে সর্বদা রোহিণীর সংবাদ লইতে লাগিল। রোহিণী রাঁধে বাড়ে, খায়, গা ধোয়, জল আনে। আর কিছুই সংবাদ নাই। ক্রমে এক দিন সংবাদ আসিল, রোহিণী পীড়িতা। ঘরের ভিতর মুড়ি দিয়া পড়িয়া থাকে, বাহির হয় না। ব্রহ্মানন্দ আপনি রাঁধিয়া খায়।
তার পর এক দিন সংবাদ আসিল যে, রোহিণী কিছু সারিয়াছে, কিন্তু পীড়ার মূল যায় নাই। শূলরোগ–চিকিৎসা নাই–রোহিণী আরোগ্য জন্য তারকেশ্বরে হত্যা দিতে যাইবে। শেষ সংবাদ–রোহিণী হত্যা দিতে তারকেশ্বরে গিয়াছে। একাই গিয়াছে–কে সঙ্গে যাইবে?
এ দিকে তিন চারি মাস গেল–গোবিন্দলাল ফিরিয়া আসিল না। পাঁচ ছয় মাস হইল, গোবিন্দলাল ফিরিল না। ভ্রমরের রোদনের শেষ নাই। কেবল মনে করিত, এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন–সংবাদ পাইলেই বাঁচি। এ সংবাদ পাই না কেন?
শেষ ননন্দাকে বলিয়া শাশুড়ীকে পত্র লিখাইল–আপনি মাতা, অবশ্য পুত্রের সংবাদ পান। শাশুড়ী লিখিলেন, তিনি গোবিন্দলালের সংবাদ পাইয়া থাকেন। গোবিন্দলাল প্রয়াগ, মথুরা, জয়পুর প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করিয়া আপাততঃ দিল্লী অবস্থিতি করিতেছেন। শীঘ্র সেখান হইতে স্থানান্তরে গমন করিবেন। কোথাও স্থায়ী হইতেছেন না।
এদিকে রোহিণীও আর ফিরিল না। ভ্রমর ভাবিতে লাগিলেন, ভগবান জানেন, রোহিণী কোথায় গেল। আমার মনের সন্দেহ আমি পাপমুখে ব্যক্ত করিব না। ভ্রমর আর সহ্য করিতে পারিলেন না; কাঁদিতে কাঁদিতে ননন্দাকে বলিয়া শিবিকারোহণে পিত্রালয়ে গমন করিলেন।
সেখানে গিয়া গোবিন্দলালের কোন সংবাদ পাওয়া দুরূহ দেখিয়া আবার ফিরিয়া আসিলেন, আসিয়া হরিদ্রাগ্রামেও স্বামীর কোন সংবাদ না পাইয়া, আবার শাশুড়ীকে পত্র লিখাইলেন। শাশুড়ী এবার লিখিলেন, “গোবিন্দলাল আর কোন সংবাদ দেয় না; এখন সে কোথায় আছে জানি না। কোনও সংবাদ পাই না |” এইরূপে প্রথম বৎসর কাটিয়া গেল। প্রথম বৎসরের শেষে ভ্রমর রুগ্নশয্যায় শয়ন করিলেন। অপরাজিতা ফুল শুকাইয়া উঠিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ভ্রমর রুগ্নশয্যাশায়িনী শুনিয়া ভ্রমরের পিতা ভ্রমরকে দেখিতে আসিলেন। ভ্রমরের পিতার পরিচয় সবিশেষ দিই নাই–এখন দিব। তাঁহার পিতা মাধবীনাথ সরকারের বয়স একচত্বারিংশৎ বৎসর। তিনি দেখিতে বড় সুপুরুষ। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে লোকমধ্যে বড় মতভেদ ছিল। অনেকে তাঁহার বিশেষ প্রশংসা করিত–অনেকে বলিত, তাঁহার মত দুষ্ট লোক আর নাই। তিনি যে চতুর, তাহা সকলেই স্বীকার করিত–এবং যে তাঁহার প্রশংসা করিত, সেও তাঁহাকে ভয় করিত।
মাধবীনাথ কন্যার দশা দেখিয়া, অনেক রোদন করিলেন। দেখিলেন–সেই শ্যামা সুন্দরী, যাহার সর্ববয়ব সুললিত গঠন ছিল– এক্ষণে বিশুষ্কবদন, শীর্ণশরীর, প্রকটকণ্ঠাস্থি, নিমগ্ননয়নেন্দীবর। ভ্রমরও অনেক কাঁদিল। শেষ উভয়ে রোদন সংবরণ করিলে পর ভ্রমর বলিল, “বাবা, আমার বোধ হয় দিন নাই। আমায় কিছু ধর্ম কর্ম করাও। আমি ছেলে মানুষ হলে কি হয়, আমার ত দিন ফুরাল। দিন ফুরাল ত আর বিলম্ব করিব কেন? আমার অনেক টাকা আছে, আমি ব্রত নিয়ম করিব। কে এ সকল করাইবে? বাবা, তুমি আমার ব্যবস্থা কর, |”
মাধবীনাথ কোন উত্তর করিলেন না–যন্ত্রণা সহ্য হইলে তিনি বহির্বটীতে আসিলেন। বহির্বটীতে অনেকক্ষণ বসিয়া রোদন করিলেন। কেবল রোদন নহে–সেই মর্মভেদী দুঃখ মাধবীনাথের হৃদয়ে ঘোরতর ক্রোধে পরিণত হইল। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, “যে আমার কন্যার উপর এ অত্যাচার করিয়াছে–তাহার উপর তেমনই অত্যাচার করে, এমন কি জগতে কেহ নাই?” ভাবিতে ভাবিতে মাধবীনাথের হৃদয় কাতরতার পরিবর্তে প্রদীপ্ত ক্রোধে পরিব্যাপ্ত হইল। মাধবীনাথ তখন রক্তোৎফুল্ললোচনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “যে আমার ভ্রমরের এমন সর্বনাশ করিয়াছে–আমি তাহার এমনই সর্বনাশ করিব |”
তখন মাধবীনাথ কতক সুস্থির হইয়া অন্তঃপুরে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। কন্যার কাছে গিয়া বলিলেন, “মা, তুমি ব্রত নিয়ম করিবার কথা বলিতেছিলে, আমি সেই কথাই ভাবিতেছিলাম। এখন তোমার শরীর বড় রুগ্ন; ব্রত নিয়ম করিতে গেলে অনেক উপবাস করিতে হয়; এখন তুমি উপবাস সহ্য করিতে পারিবে না। একটু শরীর সারুক___”