গোবিন্দলালও কিছু অপ্রতিভ হইলেন–বলিলেন, “আপনি নিদ্রা যান–আমি এমন কিছু কাজে আসি নাই|” এই বলিয়া, গোবিন্দলাল পিকদানিটি উঠাইয়া সোজা করিয়া রাখিয়া, পানবাটা উঠাইয়া যথাস্থানে রাখিয়া, নলটি কৃষ্ণকান্তের হাতে দিলেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত শক্ত বুড়া–সহজে ভুলে না–মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “কিছু না, এ ছুঁচো আবার সেই চাঁদমুখো মাগীর কথা বলিতে আসিয়াছে |” প্রকাশ্যে বলিলেন, “না। আমার ঘুম হইয়াছে–আর ঘুমাইব না |”
গোবিন্দলাল একটু গোলে পড়িলেন। রোহিণীর কথা কৃষ্ণকান্তের কাছে বলিতে প্রাতে তাঁহার কোন লজ্জা করে নাই–এখন একটু লজ্জা করিতে লাগিল–কথা বলি বলি করিয়া বলিতে পারিলেন না। রোহিণীর সঙ্গে বারুণী পুকুরের কথা হইয়াছিল বলিয়া কি এখন লজ্জা?
বুড়া রঙ্গ দেখিতে লাগিল। গোবিন্দলাল, কোন কথা পাড়িতেছে না দেখিয়া, আপনি জমীদারীর কথা পাড়িল–জমীদারীর কথার পর সাংসারিক কথা, সাংসারিক কথার পর মোকদ্দমার কথা, তথাপি রোহিণীর দিক দিয়াও গেল না। গোবিন্দলাল রোহিণীর কথা কিছুতেই পাড়িলেন না। কৃষ্ণকান্ত মনে মনে ভারি হাসি হাসিতে লাগিলেন। বুড়া বড় দুষ্ট।
অগত্যা গোবিন্দলাল ফিরিয়া যাইতেছিলেন,-তখন কৃষ্ণকান্ত প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্রকে ডাকিয়া ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সকাল বেলা যে মাগীকে তুমি জামিন করিয়া লইয়া গিয়াছিলে, সে মাগী কিছু স্বীকার করিয়াছে?”
তখন গোবিন্দলাল পথ পাইয়া যাহা যাহা রোহিণী বলিয়াছিল, সংক্ষেপে বলিলেন। বারুণী পুষ্করিণী ঘটিত কথাগুলি গোপন করিলেন। শুনিয়া কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “এখন তাহার প্রতি কিরূপ করা তোমার অভিপ্রায়?”
গোবিন্দলাল লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “আপনার যে অভিপ্রায়, আমাদিগেরও সেই অভিপ্রায়|”
কৃষ্ণকান্ত মনে মনে হাসিয়া, মুখে কিছুমাত্র হাসির লক্ষণ না দেখাইয়া বলিলেন, “আমি উহার কথায় বিশ্বাস করি না। উহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, দেশের বাহির করিয়া দাও–কি বল?”
গোবিন্দলাল চুপ করিয়া রহিলেন। তখন দুষ্ট বুড়া বলিল, “আর তোমরা যদি এমনই বিবেচনা কর যে, উহার দোষ নাই–তবে ছাড়িয়া দাও |”
গোবিন্দলাল তখন নিশ্বাস ছাড়িয়া, বুড়ার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
রোহিণী, গোবিন্দলালের অনুমতিক্রমে খুড়ার সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার বন্দোবস্ত করিতে আসিল। খুড়াকে কিছু না বলিয়া, ঘরের মধ্যস্থলে বসিয়া পড়িয়া, রোহিণী কাঁদিতে বসিল।
“এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া আমার যাওয়া হইবে না–না দেখিয়া মরিয়া যাইব। আমি কলিকাতায় গেলে, গোবিন্দলালকে দেখিতে পাইব না? আমি যাইব না। এই হরিদ্রাগ্রাম আমার স্বর্গ, এখানে গোবিন্দলালের মন্দির। এই হরিদ্রাগ্রামই আমার শ্মশান, এখানে আমি পুড়িয়া মরিব। শ্মশানে মরিতে পায় না, এমন কপালও আছে। আমি যদি এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া না যাই, ত আমার কে কি করিতে পারে? কৃষ্ণকান্ত রায় আমার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবে? আমি আবার আসিব। গোবিন্দলাল রাগ করিবে? করে করুক,-তবু আমি তাহাকে দেখিব। আমার চক্ষু ত কাড়িয়া লইতে পারিবে না। আমি যাব না। কলিকাতায় যাব না–কোথাও যাব না। যাই ত যমের বাড়ী যাব। আর কোথাও না |”
এই সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া, কালামুখী রোহিণী উঠিয়া দ্বার খুলিয়া আবার–“পতঙ্গবদ্বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ”–সেই গোবিন্দলালের কাছে চলিল। মনে মনে নিতান্ত দুঃখিনী, নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি–আমায় রক্ষা কর–আমার হৃদয়ের এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও–আর আমায় পোড়াইও না। আমি যাহাকে দেখিতে যাইতেছি–তাহাকে যত বার দেখিব, ততবার–আমার অসহ্য যন্ত্রণা–অনন্ত সুখ। আমি বিধবা–আমার ধর্ম গেল–সুখ গেল–প্রাণ গেল–রহিল কি প্রভু? রাখিব কি প্রভু?–হে দেবতা! হে দুর্গা–হে কালি–হে জগন্নাথ–আমায় সুমতি দাও–আমার প্রাণ স্থির কর–আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারি না |”
তবু সেই স্ফীত, হৃত, অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ হৃদয়–থামিল না। কখনও ভাবিল, গরল খাই; কখনও ভাবিল, গোবিন্দলালের পদপ্রান্তে পড়িয়া, অন্তঃকরণ মুক্ত করিয়া সকল কথা বলি; কখনও ভাবিল, পলাইয়া যাই; কখনও ভাবিল, বারুণীতে ডুবে মরি; কখনও ভাবিল ধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া গোবিন্দলালকে কাড়িয়া লইয়া দেশান্তরে পলাইয়া যাই। রোহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে গোবিন্দলালের কাছে পুর্নবার উপস্থিত হইল।
গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন? কলিকাতায় যাওয়া স্থির হইল ত?”
রো। না।
গো। সে কি? এইমাত্র আমার কাছে স্বীকার করিয়াছিলে?
রো। যাইতে পারিব না।
গো। বলিতে পারি না। জোর করিবার আমার কোনই অধিকার নাই–কিন্তু গেলে ভাল হইত।
রো। কিসে ভাল হইত?
গোবিন্দলাল অধোবদন হইলেন। স্পষ্ট করিয়া কোন কথা বলিবার তিনি কে?”
রোহিণী চক্ষের জল লুকাইয়া মুছিতে মুছিতে গৃহে ফিরিয়া গেল। গোবিন্দলাল নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। তখন ভোমরা নাচিতে নাচিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “ভাবছ কি?”
গো। বল দেখি।
ভ্র। আমার কালো রূপ।
গো। ইঃ-
ভোমরা ঘোরতর কোপাবিষ্ট হইয়া বলিল, “সে কি? আমায় ভাব্ছ না? আমি ছাড়া, পৃথিবীতে তোমার অন্য চিন্তা আছে?”
গো। আছে না ত কি? সর্বে সর্বময়ী আর কি! আমি অন্য মানুষ ভাবতেছি।
ভ্রমর তখন গোবিন্দলালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া, মুখচুম্বন করিয়া, আদরে গলিয়া গিয়া, আধো আধো, মৃদু মৃদু হাসিমাখা স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্য মানুষ–কাকে ভাব্দছ বল না?”