গো। তা সময়ান্তরে বলিব। তোমার বিশ্বাস হইতেছে না কেন, আগে বল।
ভ্র। তুমি আগে বল।
গোবিন্দলাল হাসিল, “তুমি আগে |”
ভ্র। কেন আগে বলিব?
গো। আমার শুনিতে সাধ হইতেছে।
ভ্র। সত্য বলিব?
গো। সত্য বল।
ভ্রমর বলি বলি করিয়া বলিতে পারিল না। লজ্জাবনতমুখী হইয়া নীরবে রহিল।
গোবিন্দলাল বুঝিলেন। আগেই বুঝিয়াছিলেন। আগেই বুঝিয়াছিলেন বলিয়া এত পীড়াপীড়ি করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন। রোহিণী যে নিরপরাধিনী, ভ্রমরের তাহা দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল। আপনার অস্তিত্বে যত দূর বিশ্বাস, ভ্রমর উহার নির্দোষিতায় তত দূর বিশ্বাসঘাতী। কিন্তু সে বিশ্বাসের অন্য কোনই কারণ ছিল না–কেবল গোবিন্দলাল বলিয়াছেন যে, “সে নির্দোষী, আমার এইরূপ বিশ্বাস |” গোবিন্দলালের বিশ্বাসেই ভ্রমরের বিশ্বাস। গোবিন্দলাল তাহা বুঝিয়াছিলেন। ভ্রমরকে চিনিতেন। তাই সে কালো এত ভালবাসিতেন।
হাসিয়া গোবিন্দলাল বলিলেন, “আমি বলিব, কেন তুমি রোহিণীর দিকে?”
ভ্র। কেন?
গো। সে তোমায় কালো না বলিয়া উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে।
ভ্রমর কোপকুটিল কটাক্ষ করিয়া বলিল, “যাও |”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “যাই |” এই বলিয়া গোবিন্দলাল চলিলেন।
ভ্রমর তাঁহার বসন ধরিল–“কোথা যাও?”
গো। কোথা যাই বল দেখি?
ভ্র। এবার বলিব?
গো। বল দেখি?
ভ্র। রোহিণীকে বাঁচাইতে।
“তাই|” বলিয়া গোবিন্দলাল ভোমরার মুখচুম্বন করিলেন। পরদুঃখকাতরের হৃদয় পরদুঃখকাতরে বুঝিল–তাই গোবিন্দলাল ভ্রমরের মুখচুম্বন করিলেন।
কৃষ্ণকান্তের উইল – ১ম খণ্ড – ১১-১৫
একাদশ পরিচ্ছেদ
গোবিন্দলাল কৃষ্ণকান্ত রায়ের সদর কাছারিতে দর্শন দিলেন।
কৃষ্ণকান্ত প্রাতঃকালেই কাছারিতে বসিয়াছিলেন। গদির উপর মসনকদ করিয়া বসিয়া, সোণার আলবোলায় অম্বুরি তামাকু চড়াইয়া, মর্ত্যলোকে স্বর্গের অনুকরণ করিতেছিলেন। এক পাশে রাশি রাশি দপ্তরে বাঁধা চিঠা, খতিয়ান, দাখিলা, জমাওয়াশীল, থোকা, করচা বাকি জায়, শেহা, রোকড়–আর এক পাশে নায়েব গোমস্তা, কারকুন, মুহরি, তহদিলদার, আমীন, পাইক, প্রজা। সম্মুখে অধোবদনা অবগুণ্ঠনতী রোহিণী।
গোবিন্দলাল আদরের ভ্রাতুষ্পুত্র। প্রবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে জ্যেঠা মহাশয়?”
তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া, রোহিণী অবগুণ্ঠন ঈষৎ মুক্ত করিয়া, তাঁহার প্রতি ক্ষণিক কটাক্ষ করিল।কৃষ্ণকান্ত তাঁহার কথায় কি উত্তর করিলেন, তৎপ্রতি গোবিন্দলাল বিশেষ মনোযোগ করিতে পারিলেন না; ভাবিলেন, সেই কটাক্ষের অর্থ কি। শেষ সিদ্ধান্ত করিলেন, “এ কাতর কটাক্ষের অর্থ, ভিক্ষা |”
কি ভিক্ষা? গোবিন্দলাল ভাবিলেন, আর্তের ভিক্ষা আর কি? বিপদ হইতে উদ্ধার। সেই বাপীতীরে সোপানোপরে দাঁড়াইয়া যে কথোপকথন হইয়াছিল, তাহাও তাঁহার এই সময়ে মনে পড়িল। গোবিন্দলাল রোহিণীকে বলিয়াছিলেন, “তোমার যদি কোন বিষয়ের কোন কষ্ট থাকে, তবে আজি হউক, আমাকে জানাইও |” আজি ত রোহিণীর কষ্ট বটে, বুঝি এই ইঙ্গিতে রোহিণী তাঁহাকে তাহা জানাইল।
গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবিলেন, “তোমার মঙ্গল সাধি ইহা আমার ইচ্ছা; কেন না, ইহলোকে তোমার সহায কেহ নাই দেখিতেছি। কিন্তু তুমি যে লোকের হাতে পড়িয়াছ–তোমার রক্ষা সহজ নহে |” এই ভাবিয়া প্রকাশ্যে জ্যেষ্ঠতাতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে জ্যেঠা মহাশয়?”
বৃদ্ধ কৃষ্ণকান্ত একবার সকল কথা আনুপূর্বিক গোবিন্দলালকে বলিয়াছিলেন, কিন্তু গোবিন্দলাল রোহিণীর কটাক্ষের ব্যাখ্যায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন, কানে কিছুই শুনেন নাই। ভ্রাতুষ্পুত্র আবার জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে, জ্যেঠা মহাশয়?” শুনিয়া বৃদ্ধ মনে মনে ভাবিল, “হয়েছে! ছেলেটা বুঝি মাগীর চাঁদপানা মুখখানা দেখে ভুলে গেল!” কৃষ্ণকান্ত আবার আনুপূর্বিক গত রাত্রের বৃত্তান্ত গোবিন্দলালকে শুনাইলেন। সমাপন করিয়া বলিলেন, “এ সেই হরা পাজির কারসাজি। বোধ হইতেছে, এ মাগী তাহার কাছে টাকা খাইয়া, জাল উইল রাখিয়া, আসল উইল চুরি করিবার জন্য আসিয়াছিল। তার পর ধরা পড়িয়া ভয়ে জাল উইল ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে |”
গো। রোহিণী কি বলে?
কৃ। ও আর বলিবে কি? বলে, তা নয়।
গোবিন্দলাল রোহিণীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা নয় ত তবে কি রোহিণী?”
রোহিণীর মুখ না তুলিয়া, গদ্গদ কণ্ঠে বলিল, “আমি আপনাদের হাতে পড়িয়াছি, যাহা করিবার হয় করুন। আমি আর কিছু বলিব না |”
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “দেখিলে বদ্জা তি?”
গোবিন্দলাল মনে মনে ভাবিলেন, “এ পৃথিবীতে সকলেই বদ্জািত নহে। ইহার ভিতর বদ্জা তি ছাড়া আর কিছু থাকিতে পারে। প্রকাশ্যে বলিলেন, “ইহার প্রতি কি হুকুম দিয়াছেন? একে কি থানায় পাঠাইবেন?”
কৃষ্ণকান্ত বলিলেন, “আমার কাছে আবার থানা ফৌজদারি কি! আমিই থানা, আমিই মেজেষ্টর, আমিই জজ। বিশেষ এই ক্ষুদ্র স্ত্রীলোককে জেলে দিয়া আমার কি পৌরুষ বাড়িবে?”
গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি করিবেন?”
কৃ। ইহার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া, কুলার বাতাস দিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিব। আমার এলেকায় আর না আসিতে পারে।
গোবিন্দলাল আবার রোহিণীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বল, রোহিণি?”
রোহিণী বলিল, “ক্ষতি কি!”
গোবিন্দলাল বিস্মিত হইলেন। কিঞ্চিৎ ভাবিয়া কৃষ্ণকান্তকে বলিলেন, “একটা নিবেদন আছে |”
কৃ। কি?
গো। ইহাকে একবার ছাড়িয়া দিন। আমি জামিন হইতেছি–বেলা দশটার সময়ে আনিয়া দিব।