যে নবীনদ্বয় প্রাসাদোপরি দাঁড়াইয়া ছিলেন; তন্মধ্যে একজন চন্দ্ররশ্মিবর্ণাভা; অবিন্যস্ত কেশভার মধ্যে প্রায় অর্দ্ধলুক্কায়িতা। অপরা কৃষ্ণাঙ্গী; তিনি সুমুখী ষোড়শী, তাঁহার ক্ষুদ্র দেহ, মুখখানি ক্ষুদ্র, তাহার উপরার্দ্ধে চারি দিক দিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুঞ্চিত কুন্তলদাম বেড়িয়া পড়িয়াছে; যেন নীলোৎপলদলরাজি উৎপলমধ্যকে ঘেরিয়া ধরিয়াছে। নয়নযুগল বিস্ফারিত, কোমল-শ্বেতবর্ণ, সফরীসদৃশ; অঙ্গুলিগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, সঙ্গিনীর কেশতরঙ্গমধ্যে ন্যস্ত হইয়াছে। পাঠক মহাশয় বুঝিয়াছেন যে, চন্দ্ররশ্মিবর্ণশোভিনী কপালকুণ্ডলা; তাঁহাকে বলিয়া দিই, কৃষ্ণাঙ্গী, তাঁহার ননন্দা শ্যামাসুন্দরী।
শ্যামাসুন্দরী ভ্রাতৃজায়াকে কখনও “বউ”, কখনও আদর করিয়া “বন”, কখনও “মৃণো” সম্বোধন করিতেছিলেন। কপালকুণ্ডলা নামটি বিকট বলিয়া, গৃহস্থেরা তাঁহার নাম মৃন্ময়ী রাখিয়াছিলেন, এই জন্যই “মৃণো” সম্বোধন। আমরাও এখন কখন কখন ইহাকে মৃন্ময়ী বলিব।
শ্যামাসুন্দরী একটি শৈশবাভ্যস্ত কবিতা বলিতেছিলেন, যথা –
“বলে – পদ্মরাণি, বদনখানি, রেতে রাখে ঢেকে ফুটায় কলি, ছুটায় অলি, প্রণপতিকে দেখে আবার – বনের লতা, ছড়িয়ে পাতা, গাছের দিকে ধায় নদীর জল, নামলে ঢল, সাগরেতে যায় ছি ছি – সরম টুটে, কুমুদ ফুটে, চাঁদের আলো পেলে বিয়ের কনে রাখতে নারি ফুলশয্যা গেলে মরি – এ কি জ্বালা, বিধির খেলা, হরিষে বিষাদ পরপরশে, সবাই রসে, ভাঙ্গে লাজের বাঁধ”
“তুই কি লো একা তপস্বিনী থাকিবি?”
মৃন্ময়ী উত্তর করিল, “কেন, কি তপস্যা করিতেছি?”
শ্যামাসুন্দরী দুই করে মৃন্ময়ীর কেশতরঙ্গমালা তুলিয়া কহিল, “তোমার এ চুলের রাশি কি বাঁধিবে না?”
মৃন্ময়ী কেবল ঈষৎ হাসিয়া শ্যামাসুন্দরীর হাত হইতে কেশগুলি টানিয়া লইলেন।
শ্যামাসুন্দরী আবার কহিলেন, “ভাল, আমার সাধটি পুরাও। একবার আমাদের গৃহস্থের মেয়ের মত সাজ। কতদিন যোগিনী থাকিবে?”
মৃ । যখন এই ব্রাহ্মণসন্তানের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই, তখন ত আমি যোগিনীই ছিলাম।
শ্যা । এখন থাকিতে পারিবে না।
মৃ । কেন থাকিব না।
শ্যা । কেন? দেখিবি? যোগ ভাঙ্গিব। পরশপাতর কাহাকে বলে জান?
মৃন্ময়ী কহিলেন, “না”।
শ্যা । পরশপাতরের স্পর্শে রাঙ্গও সোনা হয়।
মৃ । তাতে কি?
শ্যা । মেয়েমানুষেরও পরশপাতর আছে।
মৃ । সে কি?
শ্যা । পুরুষ। পুরুষের বাতাসে যোগিনীও গৃহিণী হইয়া যায়। তুই সেই পাতর ছুঁয়েছিস্। দেখিবি,
“বাঁধাব চুলের রাশ, পরাব চিকন বাস খোঁপায় দোলাব তোর ফুল! কপালে সীঁথির ধার, কাঁকালেতে চন্দ্রহার, কানে তোর দিব জোড়া দুল॥ কুঙ্কুম চন্দন চুয়া, বাটা ভরে পান গুয়া, রাঙ্গামুখ রাঙ্গা হবে রাগে। সোণার পুত্তলি ছেলে, কোলে তোর দিব ফেলে, দেখি ভাল লাগে কি না লাগে॥”
মৃন্ময়ী কহিলেন, “ভাল বুঝিলাম। পরশপাতর যেন ছুঁয়েছি, সোণা হলেম, চুল বাঁধিলাম; ভাল কাপড় পরিলাম; খোঁপায় ফুল দিলাম, কাঁকালে চন্দ্রহার পরিলাম; কানে দুল দুলিল; চন্দন, কুঙ্কুম, চুয়া, পান, গুয়া, সোণার পুত্তলি পর্য্যন্ত হইল। মনে কর সকলই। তাহা হইলেই বা কি সুখ?”
শ্যা । বল দেখি ফুল ফুটিলে কি সুখ?
মৃ । লোকের দেখে সুখ, ফুলের কি?
শ্যামাসুন্দরীর মুখকান্তি গম্ভীর হইল; প্রভাতবাতাবহ নীলোৎপলবৎ বিস্ফারিত চক্ষু ঈষৎ দুলিল; বলিলেন, “ফুলের কি? তাহা ত বলিতে পারি না। কখনও ফুল হইয়া ফুটি নাই। কিন্তু যদি তোমার মত কলি হইতাম, তবে ফুটিয়া সুখ হইত।”
শ্যামাসুন্দরী তাঁহাকে নীরব দেখিয়া কহিলেন; – “আচ্ছা – তাই যদি না হইল; – তবে শুনি দেখি, তোমার সুখ কি?”
মৃন্ময়ী কিয়ৎক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, “বলিতে পারি না। বোধ করি, সমুদ্রতীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে।”
শ্যামাসুন্দরী কিছু বিস্মিতা হইলেন। তাঁহাদিগের যত্নে যে মৃন্ময়ী উপকৃতা হয়েন নাই, ইহাতে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধা হইলেন, কিছু রুষ্টা হইলেন। কহিলেন, “এখন ফিরিয়া যাইবার উপায়?”
মৃ । উপায় নাই।
শ্যা । তবে করিবে কি?
মৃ । অধিকারী কহিতেন, “যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি।”
শ্যামাসুন্দরী মুখে কাপড় দিয়া হাসিয়া বলিলেন, “যে আজ্ঞা, ভট্টাচার্য্য মহাশয়! কি হইল?”
মৃন্ময়ী নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “যাহা বিধাতা করাইবেন, তাহাই করিব। যাহা কপালে আছে, তাহাই ঘটিবে।”
শ্যা । কেন, কপালে কি আছে? কপালে সুখ আছে। তুমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেল কেন?
মৃন্ময়ী কহিলেন, “শুন। যে দিন স্বামীর সহিত যাত্রা করি, যাত্রাকালে আমি ভবানীর পায়ে ত্রিপত্র দিতে গেলাম। আমি মার পাদপদ্মে ত্রিপত্র না দিয়া কোন কর্ম্ম করিতাম না। যদি কর্ম্মে শুভ হইবার হইত, তবে মা ত্রিপত্র ধারণ করিতেন; যদি অমঙ্গল ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিত, তবে ত্রিপত্র পড়িয়া যাইত। অপরিচিত ব্যক্তির সহিত অজ্ঞাত দেশে আসিতে শঙ্কা হইতে লাগিল, ভাল মন্দ জানিতে মার কাছে গেলাম। ত্রিপত্র মা ধারণ করিলেন না – অতএব কপালে কি আছে জানি না।”
মৃন্ময়ী নীরব হইলেন। শ্যামাসুন্দরী শিহরিয়া উঠিলেন।
কপালকুণ্ডলা – ০৩
প্রথম পরিচ্ছেদ : ভূতপূর্ব্বে
“কষ্টোঽয়ং খলু ভৃত্যভাবঃ”
রত্নাবলী
যখন নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে লইয়া চটি হইতে যাত্রা করেন, তখন মতিবিবি পথান্তরে বর্দ্ধমানাভিমুখে যাত্রা করিলেন। যতক্ষণ মতিবিবি পথবাহন করেন, ততক্ষণ আমরা তাঁহার পূর্ব্ববৃত্তান্ত কিছু বলি। মতির চরিত্র মহাদোষকলুষিত, মহদ্গুণেও শোভিত। এরূপ চরিত্রের বিস্তারিত বৃত্তান্তে পাঠক মহাশয় অসন্তুষ্ট হইবেন না।