ঠিক সেই সময় একজন সুন্দর যুবক প্রায় মহীনের সমবয়সী, এসে দাঁড়ালো কবি কবি চেহারা। লম্বা চুল, গায়ে দামী সিল্কের গেঞ্জী তবে স্বাস্থ্য খুব ভাল বলা চলে না। একখানা চেয়ারে বসতে বসতে বললো দে তোর মহীনদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে, আর এক কাপ চাও যদি দিস।
চা দিচ্ছি কিন্তু আলাপ করিয়ে দিবে হবে কেন, তুমি কি বিলেতী না আমেরিকান? কি এমন বয়স হয়েছে যে পরের লোকের সঙ্গে ইনট্টোডিউস না করলে কথা বলতে পারবে না? লক্ষ্ণৌ ঠুংরী হয়ে যাচ্ছো ছোড়দা।
তার মানে? লক্ষ্ণৌ ঠুংরী কিরে?
সবাই হেসে উঠলো কথাটা শুনে। মাধুরী একটু গম্ভীর গলায় বললো–
নয় তো কি। তোমার লক্ষ্ণৌ এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে, সঙ্গে ইনট্টোডিউস করিয়ে দেব তাকে চা খাওয়াতে হবে। ওস্তাদ গান শোনবার একজন সমঝদার স্রোতা তুমি পেলে ছোড়দা, এর জন্যে।
তোমাকে ধন্যবান দেওয়া উচিত। তোমাকে কেন ধন্যাবদ দেব।
কারণ আমিই আবিস্কার করেছি? এসো ইনট্টোডিউস করিয়ে দিই–মাল–কোশ শোনাতে হবে, তোমাদের খা সাহেবকে আজ ডেকে আনবে।
ছোড়দা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ এতক্ষণ কথা বলেনি মহেন্দ্রের সঙ্গে, ইংরেজী কায়দায় পরিচয় করিয়ে দেয়নি কেউ বলে নয়। নিতান্ত একজন গ্রাম্য যুবক।
কি কথা বলবে এই ভেবে সময়ক্ষেপন করেছিল। মহেন্দ্র গানের সমঝদার শুনে সাগ্রহে বললো–
গান বাজনার সাধনা করা হয় তাহলে?
আজ্ঞে না সাধন করবার সময় কোথায়? পেটের ধান্দায় ঘুরছি সব আছে সময় সুযোগ পেলে বসি এক আধবার মহেন্দ্র অলকা ক্লাবে।
না! অতি তীক্ত কণ্ঠে বললো মাধুরী। ওখানে ও যাবে না। ওখানে তোমাদের রাজাবাদশার মজলিসে আমাদের গরীবের মানায় না ওকে। আমি নিজেই গান শুনিয়ে আনবো কোথাও, নইলে বাড়ীতেই উস্তাদ ডাকবো।
কেন? ওখানে যেতে আপত্তি কি? আমার সঙ্গে যাবে রতীন শুধালো।
আপত্তি অনেক। ওরা সবে মহীনদাকে কৃপার চক্ষে দেখবে, বলবে পাড়া গাইয়া অশিক্ষিত গরীব। ওসব হতে দেব না আমি। চল মহীনদা, বাজারে যেতে হবে বলে মাধুরী উঠে পড়ল।
ভালো গায়কের সম্মান ওখানে খুব বেশী, জানিস ওকে সবাই লুফে নেবে।
ও তোমাদের মতো ভালো গায়ক নয়, নাকী সুরে প্যানপ্যানে গানও গাইতে পারে না। মাধুরী এগিয়ে বললো এসো দেরী হয়ে যাচ্ছে।
মহেন্দ্র উঠতে উঠতে ভাবতে লাগলো_প্যানপ্যানে নাকি সুরের গান সে যে পছন্দ করে না এ খবর মাধুরী জানলো কেমন করে? আশ্চর্য তো কথাটা কিন্তু খুবই সত্যি। ওদের বংশটা ওস্তাদের বংশ, বাবা ভাল গাইতে পারতেন। সম্ভবতঃ উমেশ কাকার মুখে মাধুরী সে কথা শুনে থাকবে। এখানে এসে মহেন্দ্র তো একবার তাতানা শব্দও করেনি অবশ্য রেডিওর গানটা শুনেছিল কিন্তু এতেই কি মাধুরী তার সংগীত প্রিয়তা সম্বন্ধে এত খবর জানতে পারলো। এই পরমাশ্চার্যের কথাটা চিন্তা করতে সে যাচ্ছে। ছোড়দা রতীন বললো–
আচ্ছা বাজার করে আসুন পরে আলাপ হবে।
হু বলে মহেন্দ্র মাধুরীর সঙ্গে গিয়ে গাড়ীতে উঠলো। বললো—
একটা অনুরোধ রাখবে মাধুরী।
অনুরোধ যখন, তখন শুনে বলা যাবে রাখবো কিনা। আদেশ হলে নিশ্চয়ই রাখতাম।
বেশ, আদেশই বললো মহেন্দ্র। খুব বেশী দামী জামা কাপড় আমার জন্যে কিনো না। আমি তো সত্যি গরীব আর অশিক্ষিতও। ভদ্রভাবে চলতে যতটুকু যা দরকার, তাই আমার জন্যে কিনে দাও। বড় মানুষী করবার আমার সখ নেই লক্ষী।
ও বাড়ীটাকে আবুহোসেনী রাজত্ব বলে মনে হচ্ছে–কেমন? আচ্ছা বোঝা যাবে।
হাসলো মাধুরী নিটোল মধুর হাসি–তারপর বললো গম্ভীর স্বরে–
আমাদের বাড়ীতে তুমি শুধু একটা গায়ে পড়া আত্মীয়ও নও। বাবা এটা সকলকে ভালো। করে বুঝিয়ে দিতে চান আর আমিও চাই। এখানে যেভাবে থাকলে বাবার সম্মান বজায় থাকে, তাই তোমাকে করতে হবে। হা, কিন্তু তার জন্যে কি মানুষ দরকার?
অবশ্য দরকার, কারণ তিনি বড় মানুষ সেলফম্যান এবং ম র্যাদায় অভিজাত। কলকাতায় আমাদের চার পুরুষের বসতি বনেদী বংশ আর তুমি সে বাবার পরম বন্ধুর ছেলে। তোমাকে কোনো ছুটকে রাজকুমারের বাড়ীতে বাজার সরকারী করতে বাবা নিশ্চয়ই। পাঠাবেন না। তুমি কেন অত কুণ্ঠিত হোচ্ছ মহীনদা?
না কুণ্ঠ নয় মাধুরী, অনভ্যাস। নিজেকে বড় মানুষ ভাবতে আমার ভয় করে। বড় মানুষ। মানে ধনী মানুষ–
হ্যাঁ, তা বুঝেছি। বেশ অন্যদিকে বড় মানুষ হও–বিদ্যায়, জ্ঞানে মানুষত্বেও সেটাই আমি হতে চাই, বলে মহেন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো। আমাকে অতবড় ঘরে পালঙ্কে না রেখে নীচের তলায় একটা ছোট ঘরে তুমি একখানা তক্তপোষে রাখলে আমি খুশিই হই মাধুরী।
না, আমি খুশী হব না। তার থেকে বরং একটা কাজকর্ম যোগাড় করে তুমি এ বাড়ী : থেকে চলে যাবে। যেখানে ইচ্ছে থাকবে গিয়ে, কিন্তু এখানে যতক্ষণ ততক্ষণ বড় লোকের ছেলের মতই থাকতে হবে অন্ততঃ আমাদের সাধারণ ভদ্রলোকের ছেলের মতো। দীনভাব আমি ভালবাসি না।
কিন্তু আমি দীন—
না। মাধুরী তীব্র প্রতিবাদ জানালো–নিজেকে দীন মনে করা অপরাধ। মানুষ অমৃতের পুত্র। দীন কেন হবে?
গাড়ীটা চৌরঙ্গীর একটা বড় দোকানের সামনে দাঁড়ালো, মাধুরী নামলো মহীনকে নিয়ে, দারোয়ানরা সেলাম জানাচ্ছে। উমেশবাবুর তিন ছেলে এক মেয়ে মাত্র যথাক্রমে অতীন যতীন, রতীন আর মাধুরী। মাধুরী সবার ছোট। তাই সকলের আদরের। বাবা মার কথা তো না বলাই ভালো, দাদারাও ওকে অত্যন্ত স্নেহ করে। কেহ কখনো ওকে এতোটুকু কড়া কথা বলে না। বড়দার থেকে ও অনেক চোট তাই বড়দার স্নেহটা আরো বেশী ওর উপর। বৌদিও।
২. বড় বৌদি জমিদার বাড়ীর মেয়ে
বড় বৌদি জমিদার বাড়ীর মেয়ে সুন্দরী সুলক্ষণা এবং সদগুণশালিনী আর এই বধুটি আসার পর থেকে উমেশবাবুর উন্নতি আশাতীত হয়ে উঠেছিল, বড় বধুর সম্মান ও বাড়ীতে বেশী। একমাত্র পুত্রসন্তান সাড়ে তিন বছরের। মেঝ ছেলে উচ্চশিক্ষিত কলকাতায় এক বিখ্যাত ব্যারিষ্টারের কন্যাকে বিয়ে করেছে সন্তানাদি এখনো হয়নি। শীঘ্রই সস্ত্রীক বিলাতে আমেরিকা যাবে বেড়াতে, কিছু বিদ্যা শিক্ষারও ইচ্ছা আছে। খেলাধুলায় ঝোঁক বেশী, ভাল ক্রিকেট খেলতে পারে। ব্যারিষ্টার কন্যাটি বিলেতী ঢঙে মানুষ হয়েছে, বাড়ীর চালচলন তার খুব পছন্দ নয় তবে যতদুর সম্ভব মানিয়ে চলতে চায়। ছোট ছেলে রতীন এম এ পাশ করে সঙ্গীত চর্চা করছে। ওদিকে খুব ঝোঁক ওর। লক্ষ্ণৌ এর একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ীর কন্যার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে। আগামী অগ্রহায়ণেই হতে পারে। ছোট মাধুরী, উইমেন্স কলেজে আই, এ পড়ে। গাড়ীতে আসে যায়। এখন পূজার ছুটি তাই অখন্ড অবসর ওর। গিন্নীমা পূজা পার্বন নিয়েই থাকেন। বড় বধুই সাহায্য করেন। আর মাধুরীও করে সাহায্য। বাড়ীতে নিত্য পূজা তো আছেই তাছাড়া ওর নিজের তপজপও যথেষ্ট আছে তাই বাড়ীর মধ্যে আলাদা একটা ঘরই আছে ওঁর জন্যে। অত্যন্ত ভক্তিমতি নিষ্ঠামতী মহিলা। কেউ যদি বলে আপনাকে ভাল কীর্তন শোনাবো, তা তৎক্ষণাৎ তাকে লুচি মিষ্টি খাইয়ে দেবেন আর কীর্তন শোনালে তো কথাই নাই। পোলাও কালিয়া খাওয়ান! নিত্য গঙ্গা স্নান করে আসেন তাই কালীগঞ্জে ওর বাড়ি করা হলো না, গঙ্গা দূর হয়ে যাবে। দক্ষিণেশ্বর প্রতি শনিবার যান শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেবের সাধানপীঠ দর্শন করতে কথামত ওর প্রায় মুখস্থ। কিন্তু নিজে তিনি মোটে লেখাপড়া জানেন না সব পড়িয়ে শোনেন। কেউ যদি গিয়ে বলে আপনাকে কথামৃত পড়ে শোনাবো, তার তখুনি ওখানে নিমন্ত্রন হয়ে গেল খাবার। পাড়ার কত চালাক ছেলে–মেয়ে ওঁর এই দুর্বলতার সুযোগ যে নেয়, তার ইয়ত্তা নাই। এইবার পূজোর আগে পাড়ার ছেলেমেয়ে এসে বললো, জেঠাইমা বা কাকিমা মাসিমা যাহোক সম্বোধন করে মহিষমর্দিনী অভিনয় হবে, মায়ের মহিষাসুর বধ লীলা আপনাকে না শোনালে আমাদের পূজোই মিথ্যে হয়।