শোন এক ছিল–চমকে উঠলো মহেন্দ্র। কান গল্প শোনাচ্ছে সে বালিশকে ছিঃ। খোকনের অকল্যাণ হবে যে। মহেন্দ্র বালিশটা ঠেলে সরিয়ে দিল। পাশ ফিরলো তারপর অকস্মাৎ উঠে পা তলে রাখা ব্যাগখানা তুলে মেঝেতে ফেলল। মহেন্দ্র নিজের মনেই বললো–
খোকনকে ছেড়ে এত ভালো বিছানায় শোয়া যাবে না–
একটা ছোট বালিশ টেনে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লো, মহেন্দ্র ঘুমিয়ে গেল নিটোল নিবিড় একটি ঘুম স্বপ্নহীন সুষুপ্তি। মহেন্দ্র যেন জীবিত ছিল না, অকস্মাৎ খিলখিল হাসির সোনার কাঠি উজ্জ্বল জলকল্লোল হাসির ঝরণা। বালিশ থেকে মাথা তুলে মহেন্দ্র দেখলো বারান্দার পাশের একটা দরজা ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে মাধুরী।
হাসিটা ওরই কিন্তু এতে হাসবার কি হয়েছে? মহেন্দ্র উঠে বসবার পূর্বেই মাধুরী বললো, যোগাভ্যাস চলছে সন্ন্যাসী ঠাকুর?
যোগাভ্যাস? না দাদা ওসব করেন। মহেন্দ্র বোকার মত জবাব দিল উঠতে উঠতে।
তুমিও করবে, দণ্ড কমণ্ডলু আমি কিনে দেব। বলে ভেতরে এল মাধুরী।
ঠাট্টা? বলে মহেন্দ্র এতক্ষণে যেন পিটা অনুধাবন করল।
ঠাট্টা কি? ওসব আমি করি না। যোগাভ্যাস কিছু খারাপ ব্যাপার নয়। আজ থেকে খাট পালং বিছানা তুলে কম্বল পেত দেব নাও উঠে পড়, সকাল অনেকক্ষণ হয়েছে। যোগের লক্ষণ ব্রহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ।
যোগের অনেক কিছু শিখে ফেলেছ দেখছি মহেন্দ্র এতো পরে বললো কথাটা সাহস করে। কাল থেকে এ পর্যন্ত মহেন্দ্র একতরফা শুনছে। আজ সাহস পেলে। হ্যাঁ যেটুকু শিখতে বাকী আছে, তোমার কাছে শিখে নেব। হাতমুখ ধুবে এসো দাদাদের চা হয়ে গেল।
তোমার? মহেন্দ্র যেতে যেতে প্রশ্ন করলো।
তোমার মত মেষ শাবকের ভার আমার ওপর, তখন তোমাকে খোয়াড় মুক্ত না করে আমি খাব কেমন করে? বলেই মাধুরী কম্বলখানা আর বালিশটা তুলে দিল। বাথরুমে ঢুকে মহেন্দ্র ভাবতে লাগলো স্নান হয়ে গেছে মাধুরীর ভিজে চুলগুলো পিঠ জুড়ে রয়েছে। মহেন্দ্র স্নানটা সেরে নেবে নাকি? কাপড় কোথায় আছে, কে জানে? আর থাকলেও এ বাড়ীতে মানাবেনা। কাজেই মুখ ধুয়ে মহেন্দ্র বাহিরে এল নিজেকে যথাসাধ্য ন্দ্র করে নিয়েছে সে এর মধ্যেই। চুলটাও আচড়ে নিয়েছে। বেরিয়ে দেখলো একটা চাকর দাঁড়িয়ে। বললো ছোটদা ডাকছেন স্যার আসুন।
মহেন্দ্র চটি পায়ে, তার পিছনে বেরিয়ে এল? বৃদ্ধ উমেশবাবু গিন্নি আর বড়বৌ বসে আছেন চেয়ারে মাধুরীকে কোথাও দেখতে পেলেন না। বৃদ্ধ বললেন এস বাবা, কাল বেশ ঘুম হয়েছিল তো।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
মহেন্দ্র বললো চেয়ারে বসতে বসতে।
কম্বলে না শুলে ওর ভাল ঘুম হয় না বাবা–বলে মাধুরী কোত্থেকে এসে দাঁড়ালো–খাটে না শুয়ে মেঝেতে কম্বল পেতে শুয়েছিল আজ ওকে একটা মৃগচর্ম কিনে দিতে হবে।
সে কিরে মা। বলে বৃদ্ধা বিস্মিত হাসিমুখে তাকালেন মহেন্দ্রের পানে? সলজ্জ মহেন্দ্র বললো–
আজ্ঞে না অত ভালো বিছানায় শোয়া তো, অভ্যাস নেই। অভ্যাস করাটাও ঠিক হবে না তাই–
কৃচ্ছ সাধন করেছিলেন বললো মাধুরী বেশ তো, ঐ অশ্বথ গাছটার তলায় মৃগচর্ম পেতে দেবো।
বসলো মাধুরীও রুটিতে মাখন লাগিয়ে গিন্নী মা প্লেটখানা এগিয়ে দিলেন। বললেন ওসব করো না। বাবা, ব্যাটাছেলে রোজগার করবে, চিরদিন কি কেউ গরীব থাকে। তোমার এই কাকাই তখন সি, পিতে যান সামান্য সম্বল নিয়ে, তখন আমাদের অবস্থাও খুব খাটো। ছিল। তোমার বাবার অবস্থা তখন আমাদের চেয়ে ভালো।
মহেন্দ্র কিছু বললো না, চুপ করে খেতে লাগলো। মাধুরী ওর চা ঠিক করে দিতে দিতে বললো ভালো করে দিনকতক খাও, শরীরটাও অল্প সারুক তারপর কম্বলে না হয় শোবে কোপীন পরবে কচুপেড়া খাবে যা খুশী করবে। মহেন্দ্র এবারেও কথা কইল না, একটু হাসলে মাত্র। উমেশবাবু বললেন কিছু টাকা আজই পাঠিয়ে দাও তোমার দাদার নামে লিখে দাও তুমি এখানেই রয়েছে ওরা যেন না ভাবে।
চাকরী বাকরি একটা কি জুটবে? অতি ক্ষীণ কন্টে বললো মহেন্দ্র।
অত ব্যস্ত কেন, বাবা? এখানে তুমি নিজের বাড়ীতেই আছ মনে করবে। চাকরির কথা এবার আমি ভাববো এতোকাল বন্ধুর ছেলেদের খবর নিইনি এ যে আমার কতবড় অপরাধ, তা আমি বুঝেছি। মাধুমা, টাকাটা তুই নিজেই মানি অর্ডার করিয়ে দিস আর জুতোজামা কাপড় সব কিনে দিবে যা।
শীত আসছে, বাবা গরম কোর্ট শার্ট দরকার।
না, ওসব না। আমার খোকনের সুতার গেঞ্জী রয়েছে।
মহেন্দ্র এমন আকস্মিক আর্তকণ্ঠে কথাটা বলে উঠলো যে উপস্থিত তিন জনেই ওরা করুণ এই আবহাওয়াটাকে শীত পড়তে দেরী রয়েছে, তার আগেই তোমার খোকনের জামা কাপড় তৈরী হয়ে যাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অবধি কতবার খোকনের কথা ভেবেছ। মহীনদা?
ও ছাড়া কিছুই আর ভাবী না, মাধুরী। অন্ধ দাদা খোকনের মতই বয়স থেকে আমায় মানুষ করেছেন তার কথাও ভাবি না। যোগী পুরুষ অদ্ভুত অসাধারণ মনঃশক্তি–অভাবকে তিনি অবহেলায় অগ্রাহ্য করেন বৌদি তার যোগ্য সহধর্মিণী কিন্তু আমি বড় দুর্বল–
তাই সবল হওয়ার জন্যে কাল কম্বল পেতে ছিলে? বড় বৌ বললো এতক্ষণে।
না বৌদি খোকনকে কখনো ভাল বিছানায় শোয়াতে পারিনি, ফুলের মত ছেলে, ঘুটিং বেরুনো শানে পড়ে থাকে–
ব্যাটাছেলের ঐ রকম ভাবেই মানুষ করতে হয় বললো মাধুরী। নইলে ঐ দেখো না আমার ছোড়দা ললিতা লবঙ্গলতা, একটা পালং এ আটখানা বালিশ দেড় হাত মোটা গদী আর সিল্কের চাদর না হলে ঘুমুতে পারে না।