বাইরের ঘরটায় দেবেন্দ্র বসে থাকেন। চোখ নাই, চোখ নাই তাই পড়াশুনা বন্ধ কিন্তু বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি কাব্য ব্যাকরণ স্মৃতি কণ্ঠ স্বর তাই বহু লোক আসেন তার কাছে বিধান নিতে, ভগবত্ব আলোচনা করতে, সকথা শুনতে। বংশের একটা ছেলে পণ্ডিত হোক, এই ইচ্ছায় ওর বাবা ক্ষেত্ৰনাথ ওকে কাশীতে পড়িয়েছিলেন সংস্কৃত। অভাব ছিল না তাই সখ
হয়েছিল। অন্ধ না হলে অর্থ ভালোই উপার্জন করতে পারতেন দেবেন্দ্র।
ইংরেজীও ভালো জানেন কিন্তু চোখ আর নাই, বিশ্ব তার কাছে অন্ধকার। এখন সম্বল ঈশ্বরের অনুধ্যান তাহার তপস্যা। ইচ্ছে আছে ঈশ্বরীর কথা কিছু লিখবেন। কিন্তু নিজে লিখতে অক্ষম তাই হয়ে ওঠে না? ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মতামত শোনাবার একটা লোকও নাই, যারা আসেন বাড়িতে, তাদের কাউকেও ধরে কখনো পড়িয়ে শোনেন।
নিত্যকর্ম শেষ করে উনি বসেছিলেন তক্তপোষে, কেউ আজ আসেনি। সকলেরই তো বিজয়াদশৰ্মী, প্রতি বাড়িতে উৎসব। বড় ইচ্ছে করতে লাগলো। জগ্যমাতার সপ্তশতী স্তোত কিছু শোনেন কিন্তু কে ওকে চণ্ডীমণ্ডপে নিয়ে যাবে অনেকটা দূরে বাবুদের চণ্ডীমণ্ডপ সেখানেই যেতে হবে। বর্ষার গ্রাম্য পথ পঙ্কিল এবং পিচ্ছিল হয়। লাঠি ধরে তিনি একা যেতে পারবেন না কিন্তু আজ একটু চণ্ডীপাঠ শুনতে হয়। বিশেষ করে মহেন্দ্রের কল্যাণ কামনা করবার জন্যে চণ্ডীমণ্ডপে যেতে হবে ওকে। ডাকলেন–
খোকন?
উঁ যাই–
খোকন নিতান্ত নিরুপায় ভাবে খেলা ছেড়ে এসে দাঁড়ালো, বললো—
কি?
জামাটা পরে আয় তো বাবা, আমাকে একবার ঠাকুর দেখিয়ে আনবি।
আচ্ছা বলে খোকন চলে গেল। ঠাকুর দেখিয়ে আনবে, কথাটা উনি যেন বিদ্রূপ করেই বললেন অভিমান করে। অনন্ত জগতে বিধাত্রী যিনি, তাঁরই বিধানে ঐ দশভুজা রূপ দেখবার শক্তি আর নাই দেবেন্দ্রের। অন্তরে চিন্ময় মুর্তির ধ্যান ছাড়া কিছুই তিনি আর করতে পারেন না কথাটা তাই বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। খোকন জামাটা গায়ে দিয়ে এসে বললো—
কৈ লাঠিটা কোথায় বলেই কোন থেকে বাঁশের লাঠিগাছ নিয়ে বললো–এসো বাবা।
লাঠি অন্যপ্রান্ত ধরে দেবেন্দ্র উঠলেন? খোকনের অভ্যাস আছে ওকে এভাবে নিয়ে যাওয়া–অতি সাবধানে নিয়ে যায় ঈশ্বরের কৃপার দান খোকন।
বাবুদের চণ্ডীমণ্ডপের বহু ভাগীদার, এই উৎসব তেমন হয় না, শুধু প্রতি অংশীদার সগর্বে প্রচার করতে চায়, সেই যেন মালিক প্রজার। দশ পনের বছর আগে পূজার দিনে গ্রামস্থ সকলকে আহ্ববান করা হতো, কেউ অনাহুত গেলে প্রচুর আদর আপ্যায়ন পেতো। কিন্তু এখন কেউ গেলে মালিকেরা কৃপার দৃষ্টি তাকান যেন ওরা পূজা করেছেন বলেই নিতান্ত হতভাগা গ্রামবাসীরা প্রতিমা দর্শন করতে পারলো। কাছাকাছি দুতিনখানা গ্রামে প্রতিমা পূজা নাই, তাই বিসর্জন দেখবার জন্য চারপাশের গ্রাম থেকে সন্ধ্যাবেলা বহু লোক আসে ছেলে মেয়ে পর্যন্ত। কিন্তু বাবুদের খোশখেয়াল এমনি তারা প্রতিমা বের করতে রাত বারোটা বাজান, নিরাশ হয়ে দূরের লোক ফিরে যায়। গ্রামের ছোট ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ে। বাবুরা বিজয় গর্বে বিসর্জন করে এসে খাটে শুয়ে ভাবতে থাকেন ভাগ্যি তাদের বাড়ি পূজা হয়েছিল। তাই এত লোক বিসর্জন দেখলো।
গ্রামে যার দু’পয়সা আছে সে গেলে বাবুরা খাতির করেন ভালোই, কিন্তু দেবেন্দ্রর মত নিঃস্ব ব্যক্তির সেখানে কোন সম্মান নাই, কৃপার দৃষ্টিপাতও কম হয় তার প্রতি কারণ ধন না থাকলেও বিদ্যা তার আছে এবং মাথা তিনি কোথায়ও নিচু করেন না। ছেলের সামনে দেবেন্দ্র। গিয়ে দাঁড়ালেন। চণ্ডীমণ্ডপের বহু লোক প্রায় সকলেই অংশীদারদের পরিবার কেউ কেউ একবার তাকালেন ওর মুখের পানে। কিন্তু দেবেন্দ্র ওদের কাছ থেকে সম্মানলাভের প্রত্যাশায় যান নাই। মন্ডপের দাওয়ায় না উঠেই তিনি খোকনকে বললেন মার মূর্তির সামনেই আমাকে দাঁড় করা? খোকন ঠিক তাই করলো। ভেতরে চণ্ডীপাঠ চলছে। দু’একজন বললেন এখানে আসুন মুখুৰ্য্যেমশাই, আসুন দেবুদা।
থাক ভাই এখান থেকেই শুনছি। পুরোহিত তখন পড়ছিলেন–
প্রশতানাং প্রসীদ তং দেবী বিশ্ববিত্তিহারিণি।
ত্রৈলোক্যধাসিনামীড্যে লোকাং বরদাভব।
দেবেন্দ্র ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। সুন্দর পালঙ্কে পুরু বিছানায় শুয়ে মহেন্দ্র ভাবতে লাগলো স্বপ্ন রূপকথার শোনা ব্যাপারটাই সে স্বপ্নে দেখছে। হাওড়া ব্রীজের উপর রাত যাপন, ভিক্ষুক হয়ে ভোজন স্বর্গ ছাড়া কি আর। তারপর এই বিশাল পালঙ্কে শয়ন এমন আজগুবি স্বপ্ন কম লোকেই দেখে, কিন্তু এটা কি সত্যি স্বপ্ন? নিজের হাতের আঙ্গুল কামড়ে মহেন্দ্র পরীক্ষা করলে ব্যথা বোধ হয়। বেডসুইচটা পিটে আলো জ্বালালো, ঠিক জ্বলছে। উঠে কয়েক পা পায়চারী করলো, হ্যাঁ ঠিক বলা যায় তাহলে স্বপ্ন নয়, সত্যিই সে তার পিতৃবন্ধুর বাড়ীতে রয়েছে কলকাতার প্রাসাদে।
দেওয়াল ঘড়িতে সাড়ে বারো। বাইরের রাস্তায় এখনও বিসর্জনের বাদ্য কোলাহল জানালাপথে আকাশচারী ফানুশ দু’একটি দেখা যাচ্ছে। হাউই ছুটছে, পটকার আওয়াজ আর নীচে বাগান থেকে উঠে আসছে হাসনাহেনা ফুলের মদির গন্দ। অপূর্ব আবেষ্টনী অদ্ভুত পরিবেশ।
মহেন্দ্র আবার শুলো–সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিল, চোখ বুজলো ঘুমুবে এবার। খোকনকে মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলো। তার শিশু দেবতার আশ্রয় নিতে চাইল, কিন্তু আশ্চর্য কিছুতেই খোকনের মুখোনা মনে পড়ছে না। হোল কি তার আজ? খোকনকে মনে পড়ে না। এমন অসম্ভব ব্যাপার তার জীবনে আর কোনদিন ঘটেছে কি? না তো। কিন্তু খোকনকে এভাবে মনে করবার চেষ্টা সে করেনি কোনদিন। হয়তো খুব বেশী প্রিয়জনকে ধ্যান করা যায় না, অনেক সময় মহেন্দ্র চিন্তা করতে লাগলো গলা জড়িয়ে বলছে একটা গল্প বল না, কাকু?