চল ঐ নৌকায় বসে, তোমার কাকু এখানে আমায় প্রণব নাদ শোনাতঃ টেনে আনলো খোকনকে। জীর্ণ সেই নৌকাটা সযত্নে বাধা আছে।
ডুববে না, বসো এখানে কোথায় থাক খোকন?
লেবুতলায়, খোকন কথাটা শেষ করবার পূর্বেই মাধুরী, আবার বললো–
তুমি আজ আমার কাছে থাকবে। কাকুকে বলবে আমার কাছে ছিলে এই বিজয়া দশমীতে। বসো তোমার জন্যে খাবার আনতে বলি, বলেই মাধুরী ডাক দিল জোরে–
যত রকম ভাল খাবার আছে, নিয়ে আয় এখানে। খোকনকে বললো–ঝিলের জলেই হাত মুখ ধোবে নাকি বাথরুম যাবে?
না, এখানেই ধুই, বেচে গেল খোকন। চোখের জলটা ধুয়ে ফেলো। ঝিলের জলে মাধুরী লক্ষ্য করে নাই, কি এক স্বর্গীয় আনন্দে ও ভরপুর। তোমার কাকুর স্বাস্থ্যটা এখন নিশ্চয় ভাল হয়েছে, না খোকন?
আরেক আঁজলা জল চোখমুখে দিয়ে খোকন কান্না চাপলো। রাশীকৃত খাবার নিয়ে এল ঝি সন্দেশ রাবড়ি রসগোল্লা, দৈ কিন্তু মাধুরী খোকনকে বলল কাকু তোমার দুধ খাওয়াতে পারেনি ছোটবেলায়, সে কি দুঃখ তার। তাই আমি এখানে সব খোকা খুকুদের দুধ খাওয়াই, মা তো দুধই খাওয়াবে কি বল?
হ্যাঁ খোকন আরেক আঁজলা জল ছুঁড়ে দিল চোখে মুখে।
এখন তো দুধ খেতে পাও খোকন?
হ্যাঁ, গাই আছে আমাদের বাড়িতে। কথাটা বলে শেষ করবার আগে আগেই মাধুরী বললো তোমার কাকু তাহলে ভালই রোজগার করে। ঘর সংসার শ্রী ফিরিয়েছে কেমন? তোমাকে তো কলকাতায় রেখে পড়াচ্ছে তোমায় ছেড়ে সে থাকতে পারে তো? দিনের মধ্যে কতবার যে তোমার নাম করতো–হাসছে মাধুরী।
আর সামলাতে পারছে না খোকন। কান্নায় ফেটে পড়ছে চোখ দুটো ওর। পকেট থেকে আধা ময়লা রুমালটা বের করে কড়কড়ে মুখ মুছছে, প্রকাশ হয়ে যাবে হয়তো কাকুর মৃত্যুর সংবাদ। না, কান্না ওকে রোধ করতেই হবে, খোকন অতি কষ্টে নিজেকে সামলাচ্ছে। কাকু যে এর মাঝে আজো জীবিত, কি করে খোকন জানাবে এঁকে মৃত্যু সংবাদ, না জানাতে পারবে না খোকন এই স্বপ্নময়ীর ঘুম ভাঙাবে না সে।
এসো, মাধুরী একটা সন্দেশ তুলে ওর মুখে দিচ্ছে– স্নেহশীতল মাতৃহস্ত বললো–বাজারের নয়, আমি নিজে তৈরী করেছি, দুধ ছানা সব এখানে তৈরি করি। তোমার কাকুকে বলো, তার খোকনের মত হাজার খোকন নিত্য দুধ খায়। খাও, মুখে দিয়ে বললো–
এতো মিষ্টি গলা তোমার। গান শিখছো খোকন?
হ্যাঁ অল্প, কথা খোকন বলতে পারছে না, অসহ্য আর্ততায় স্বরটা গলায় আটকে যাচ্ছে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায় সর্বাঙ্গ। কিন্তু আবার বললো মাধুরী তোমার কাকুর সেই সেতারটা বাজায় তো খোকন? এখনো সেটা বাজে?
হ্যাঁ খুব ভাল বাজে! অত ভাল সেতার আর নেই ওখানে।
আচ্ছা, তোমাকে আরেকটা কিনে দিব আমি। খাও সবগুলো খাও লক্ষ্মী ছেলেটি, খেয়ে নাও। শেষে দুধ খাবে, ওর সর্বাঙ্গে হাত বুলুচ্ছে মাধুরী, পুত্র বিরহিনী মা যেন।
তোমার আর তো ভাই বোন নেই।
না, ওগুলো কি ফুল? খোকন নিজেই সামলাবার জন্যে কথা পালটাতে চায়।
ওগুলো? তোমার কাকুর ভাষাতেই বলি, ও নিজেই ওর পরিচয় যেমন তোমায় দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম হাসলো মাধুরী অম্লান সুন্দর হাসি গিলতে পারছে না, অশ্রুবাষ্প আটকে আছে গলায়, বললো–
আর খেলে হাঁটতে পারবো না, দুধটা খাই চোখের জল আবার সামলালো গেলাসের আড়ালে।
সে কি তোমাদের সবই অমনি। তোমার কাকুও খুব কম খায়, খাবে ভালো করে।
হ্যাঁ, খোকন চোঁ চোঁ করে দুধ গিলছে।
আস্তে আস্তে খাও। চল, তোমায় ভেতরে নিয়ে যাই।
আমি কাউকে কিছু বলে আসিনি, সবাই খুঁজবে বলে খোকন দুধের গ্লাসটা নামিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে যাবার আগেই মাধুরী আঁচল দিয়ে মুছে দিল বললো–
নাইবা গেলে আজ। আমার সঙ্গে গাড়ীতে বসে প্রতিমা বিসর্জন দেখবে। তোমার কাকুর সঙ্গে এই কথা আছে আমার তারপর সারারাত তোমাদের বাড়ির গল্প শুনবো।
হ্যাঁ, কিন্তু না আমার মামাতো বোনকে সঙ্গে নিয়ে বিসর্জন দেখতে যাব, না গেলে সে কাঁদবে। তাছাড়া বিজয়ায় প্রণাম করতে হবে, মিথ্যাই বললো খোকন। মানুষের যে মিথ্যা বলার কত দরকার আর সামলাতে পারছে না। পালাতে পারলে বাঁচে সে। মাধুরী বললো
বেশ যাবে, হাসলে মাধুরী, হাতটা ধরে টেনে বললো, বলেই চলেছে–
তোমার কাকুকে একবার আসতে বলো খোকন, বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। বলো যে পথিবীর আদিম দিন আর নেই সে এখন ফলে ফুলে ভর্তি, অগণ্য তার সন্তান সন্তান এখন মেঘের আড়াল থেকে বেরুতে পারে।
হাসলে মাধুরী, হেসে বললো
তোমার কাকুর চিন্তা আর ভাষা অসাধারণ কিনা তারই ভাষায় বললাম কথাগুলো। এসো–
খোকন নত হয়ে প্রণাম করবার ছলে চোখের জলটা সামলে নিল আবার কিন্তু মাধবী সস্নেহে ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলছে–
বলো যে “মধু জমলে মোম হয় তখন আর গড়িয়ে যায় না” হাসছে মাধুরী
ওটা তোমার কাকুর জন্য, ও তোমার বুঝে কাজ নেই। আসতে বললো তাকে একবার
খোকন আর কথা কইতে চাইছে না, কইতে পারছে না।
ওকে এগিয়ে দেবার জন্যে মাধুরী সেই ছোট দরজাটার কাছে এলো। খোকন আবার প্রণাম করলো ওকে। মাথায় হাত দিয়ে বললো–
বেঁচে থাকো। বংশের গৌরব হয়ে বেঁচে থাকো।
ঠিক কাকুরই শেষ কথাটা,খোকন গট গট করে হাঁটছে।
ওকে একটিবার আসতে বলো খোকন মাধুরীর কণ্ঠ ঝংকার দিল আবার।
খোকন চলতে চলতে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দ্রুত হেঁটে চলছে। পালিয়ে যেতে হবে, যত শীঘ্র পারে ওর কাছ থেকে পালাবে খোকন।