প্রকান্ড প্যান্ডেল, অসংখ্য লোক দেখছে এই দীপ্তময়ী দেবীকে, গান হোল আবৃত্তি হলো, খেলাও হলো, পুরস্কার বিতরণ চললো, অতঃপর সারি দিয়ে দাঁড়ালা বালক বালিকাদের পোশাক বিতরণ চলছে, কতক্ষণ লাগাবে কে জানে। হয়তো রাত হয়ে যাবে, যাক তবু খোকন দেখা করবেই ওর সঙ্গে। কিন্তু তার কাছে যাবে কি করে? যা ভিড়। আর উনি যে মাধুরী দেবী, তাও তো জানা নেই। ওঁর নাম কি লক্ষ্মী দেবী? আপন মনে ভাবছে খোকন এক কোনে দাঁড়িয়ে। যা হয় হবে, ওকে গিয়েই শুধোবে খোকন মাধুরী দেবী কে?
কিন্তু এই ভিড়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সে অপেক্ষা করতে লাগলো।
জিজ্ঞেস করে জানলো, ইনি চিরকুমারী। মানব সেবাই এর ব্রত, গরীবের মা বাপ ইনি। লোকে একে পূজা করে বললেই হয়।
একটা বাচ্চা মেয়ে লাইনে, এগুতে পারছে না ভয়ে দেখে উনি বলছেন আয়, চলে আয় মা, ভয় কি? নিজেই এসে কোলে নিলেন মেয়েটাকে, তারপর তার ময়লা ছেঁড়া ফ্রকখানা খুলে নতুন রঙিন ফ্রক আর ইজের পরিয়ে চুমা খেলেন, বললেন, তোমরাই সব আমার খোকা খুকু।
সমবেত জনতা জয়ধ্বনি করে উঠলো, লক্ষীমার জয় হোক। হাত ইশারায় থামতে বললেন দেবী, আবার চললো বিতরণ। অতঃপর দুঃখী মেয়েদের শাড়ী দিয়ে সিন্দুর দিয়ে, চিবুক ছুয়ে আদর করলেন। সবাই প্রণাম করছে ওকে।
খোকনের মনে হচ্ছে, নিশ্চয় উনি মাধুরী দেবী? ছুটে গিয়ে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে ওর।
অপরাহ্ন হয়ে গেল এসব শেষ হতে, অভুক্ত ক্লান্ত লক্ষীমা ভেতরে ঢুকলেন, আর জয়গান করতে করতে ঘরে ফিরলো অন্য সকলে। শূন্য প্যান্ডেলটায় খোকন একা। লাজুকে খোকন দেখা করতে পারলো না। সেও ক্লান্ত অভুক্ত অসুস্থ বোধ করছে, ফিরে যাবে নাকি খোকন? চোখের সামনে ফটকটা বন্ধ হয়ে গেল।
শূন্য প্যান্ডেল ছেড়ে খোকন বাগানের পাশে গলি রাস্তাটায় এসে আনমনে চলতে লাগলো। শুনতে পেল, ভেতরে রেকর্ড বাজছে, তার কাকুর গলা, দোতলার পানে চাইল খোকন, না কিছু দেখা যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে গানখানা, খোকন আবার তাকালো দোতলার পানে। নিজের গলাটাও ওর সঙ্গে মিশিয়ে দিল—
তোমার আমার মিলন হবে ঐ খানে ঐ সন্ধ্যারাতে—
বিরহিনী বসুন্ধরা আলোর লাগি যেথায় জাগে।
ঐখানে ঐ সাগর বেলায়,
আকাশ যেথায় আবেশ ভরে অসীমতার পরশ লাগে।
জীবন সেথায় জেগে থাকে অতন্দ্র ঐ তারা পারা সঙ্গীতে আর সৌরভে যার বিরাম বিহীন প্রেমের ধারা—
লীলা কমল নিত্যা হেথায় গন্ধ মধু বিলায়ে যায়, মরণ হারা সেই যমুনার কুলে মিলন তরী।
খোকন গাইছে রেকর্ডটার সুরের সঙ্গে—
মরণহারা সেই যমুনার চির রাধাশ্যাম জাগে।
কে? কে ওখানে?
প্রশ্ন করেছেন জানালায় দাঁড়িয়ে সেই করুণারূপিণী দেবী। মুখ বাড়িয়ে দেখলেন খোকনকে, আবার সন্দেহ কণ্ঠে ধ্বনিত হলো—
কোখেকে কে আসছে? কি তোমার নাম?
আগ্রহ যে অতিরিক্ত বেড়ে গেছে তাঁর। কী এক প্রত্যাশায় চোখ মুখ দীপ্ত হয়ে উঠেছে। কথা বলতে বলতে ছুটে নেমে এসে ওদিকার ছোট দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন–খোকন তার অবয়ব দেখতে পায়। হ্যাঁ বস্ত্র বিতরণ করছিলেন ইনি লক্ষ্মী মা। দেবী আবার বললেন—
তোমাকে যেন খুব চেনা মনে হচ্ছে, কাকে চাইছো? কেন এখানে দাঁড়িয়ে?
মাধুরী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। তিনি কি থাকেন এখানে?
হ্যাঁ, আমার নাম। এসোঁ। তা কে তুমি? তুমি কে, যেন চিনেই ফেলেছে ওকে, এমনি তার মুখের ভাব।
হ্যাঁ মহেন্দ্র মুখোজ্যের ভাইপো আমি, বলে খোকন প্রণাম করতে যাবে—
কোলে মাধুরী ওকে টেনে নিল। এসো মানিক, এসো আজ বিজয়া দশমী। মহীনদা ভাল আছে তো খোকন? তোমাকে পাঠিয়ে—
মাধুরী টেনে বাগানের ভিতরে আনছেন খোকনকে, এ অবস্থাতে বলল তোমাকে মুখ দেখেই চিনতে পেরেছিলাম তোমার কাকুর মতন গড়ন কিনা, আর গলাটও তেমনি মিষ্টি। এস, সবাই ভাল আছে তো খোকন তোমার মা বাবা আর? কথাটা শেষ করলো না, হয়তো মহীনের স্বীয় কথা শুধাতে চায়। একেবারে ঝিলের ধারে নিয়ে এল খোকনকে, কথা বলে। চলছে মাধুরী তুমি তো ওর ভাইপো, মহীনের ক’টি ছেলেমেয়ে খোকন?
বিয়ে তো করেননি, কাকু। ছেলেমেয়ে নেই।
অ্যাঁ, বলে আকস্মাৎ মাধুরী যেন অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো, পর মুহূর্তেই সুন্দর হাসিতে মুখ স্নিগ্ধ সুন্দর হয়ে উঠলো, সে মুখ এতো সুন্দর আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন বিয়ের কনে, অনুরূপ–সে মূর্তি।
দেখলো খোকন, তার অনুভূতিময় অন্তর দিয়ে অনুভব করলো মাধুরীকে আপনার প্রেমে আপনি পরিপূর্ণ এক গরীয়সী রাধা যেন।
ভাবছে খোকন, কাকুর বিষয় কিছুই ইনি জানেন না, এর লেখা চিঠিতেই সেটা বোঝা যায় কাকুর কথাটা জানাবার জন্যেই খোকন এখানে এসেছে আজ কিন্তু কেমন করে জানাবে খোকন। আরেকবার চেয়ে দেখলো ঐ দীপ্তিময়ী কে। মাধুরী বলছে
বিয়েই করলো না? আশ্চর্য। ভেবেছিলাম ওকে হারিয়ে। আচ্ছা থাক ও কথা। হাসিটা চাপাতে পারছে না মাধুরী, কিন্তু স্নেহের উজ্জ্বলতা ওকে নবোঢ়া বধু থেকে সন্তানের জননী পর্যায়ে উন্নীত করে দিল, ঝিলের ঘাটে আনলো খোকনকে। বলল
এই যে ছেলে, এখানে দাঁড়াও আমার কোল ঘেঁষে। হ্যাঁ তোমার কাকু বলে, বিশ্বে যত মা সবার চেহারা এক রকম দেখতে। আমার চেহারাটা এই রকম হয়েছে কিনা? হাসছে মাধুরী, হাসছে খোকনের মুখ পানে চেয়ে। একি উচ্ছাস এক দুকুলপ্লাবী স্নেহের স্রোতস্বিনি। কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে খোকনের। কি করে সামলাবে খোকন।