খোকনদের কলেজ বন্ধ হয়েছে। পূজা উপলক্ষে তার মামাও ছুটি পেয়েছেন, সবাই বাড়িতে গেলেন। খোকনকেও নিতে চেয়েছিলেন সঙ্গে কিন্তু গেল না খোকন। কারণ এই সময়টাতে খোঁজ করা যাবে ব্রজধাম।
মামা বিদায়ের পর বেরিয়ে পড়ল খোকন। ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল দক্ষিণ কোলকাতায়, পরিশ্রান্ত হয়ে একটা গাছের নীচে বসল খোকন। জিজ্ঞেস করল তাদের কাছে কোথায় যায়। তার জবাবে তারা ব্রজধামের কথা বলল। চমকে উঠল খোকন এবং তাদের সঙ্গে পথ ধরল। যেতে যেতে একজনকে জিজ্ঞেস করল কে থাকেন সেখানে।
তাও জান না মা লক্ষী থাকেন।
কে মা লক্ষ্মী?
কে আবার মা, লক্ষী, তাকে কে না চেনে এই কলকাতায়?
ব্রজধামে শুনে খুশীই হয়েছিল, কিন্তু তার অধিবাসিনী মা লক্ষ্মী, কে এই মা লক্ষ্মী তার কাকুর মাধুরী, না অন্য কেউ? গিয়েই দেখা যাক না।
ব্রজধামে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল খোকন। কত আয়োজন কত ব্যবস্থা। কিন্তু কে, যার জন্যে সে এতটা দূরে এসেছে, তাকে কোথায় পাওয়া যাবে জিজ্ঞাসা করল খোকন। লক্ষ্মী দেখা দেন না কাউকে
হ্যাঁ দেখা দেন তিনি সন্তানদের। তবে এই সময় বড় ব্যস্ত। দশমীর দিন এসে সেদিন তিনি স্বহস্তে কাপড় বিতরণ করবেন, দুগ্ধ বিলাবেন। বিজয়া দশমীর দিন আসবে সে, দেখবে মা লক্ষ্মীকে, চলে যাচ্ছিল? হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা গাড়ী ছুটে গেল। খোকন সেদিকে চাইতেই আরোহীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই অন্তর তার শ্রদ্ধায় ভরে উঠল সত্যিই লক্ষ্মী এই মহিলা। খোকনের দৃষ্টি অনুসরণ করল কোথায় যান তিনি। গাড়ীটা রাস্তার পাশে থামল ডাক বাক্সটার কাছে। খোকন চেয়ে দেখলো মহিলা সেখানে নামলেন। হাতে তার একটা নীল খাম, হ্যাঁ হ্যাঁ সে খামই ত যে খাম পর পর ৯ খানা সাজানো রয়েছে তাদের বাড়ীতে। আজ অষ্টমী হ্যাঁ আজইত ডাক করতে হবে বিজয়ার দিন পৌঁছাবার জন্যে। এই দিনই ত কাকুর নামে উপস্থিত হয় এই নীল খাম। অস্থির হয়ে পড়ল খোকন, দৌড়ে গিয়ে পায়ে লুটিয়ে কিন্তু ততক্ষণে মহিলা গাড়িতে উঠে ছেড়ে দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে খোকনকে ফিরতে হল বাড়ী।
আজ বিজয়ার দিন, খোকন আগে থাকতেই তৈরী হয়েছিল, ভোরে উঠেই ব্রজধাম গিয়ে হাজির হল। আশ্চর্য হয়ে সে আয়োজনের সমারোহ দেখে,
অষ্টমীর দিন স্বহস্তে চিঠিখানা ডাকে দিয়েছে মাধুরী। প্রতি বৎসর দেয় আজ দশমী, মহেন্দ্র আজ পাবে চিঠিটা। মুখখানা হাসিতে অনুরঞ্চিত হয়ে উঠলো সকাল থেকে অকারণ পূলকে মনটা স্পন্দিত হচ্ছে, না মস্ত বড় কারণ আছে, আজ বিজয়া দশমী মাধুরীর জীবনের বিশেষ দিন।
স্নান সেরে মহেন্দ্রের ফটোখানা সাজালো মাধুরী ফুল পাতা দিয়ে। ধুপ জ্বেলে দিল, প্রণাম করলো, তারপর বারান্দায় এসে দেখলো। লোকারণ্য, বিনামুল্যে আজ দুধ আর মিষ্টি বিতরণ করবে সে পাড়ার সব ছেলেমেয়েকে। বিকালে প্রত্যেক মেয়েকে মালা আর ফুলগুচ্ছ দেয়, আর দেয় নতুন জামা কাপড় গরীব ছেলেমেয়কে। এ পোষাক পরে তারা বিসর্জন দেখতে যায় এ পাড়ায়। দেখলো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দুধ নিচ্ছে, সবাই হাসি মুখ হৈ হুল্লার মধ্যেও আনন্দ। তৃপ্তির হাসি ফুটলো মাধুরীর মুখে। এই গরীবদের মুখে যদি হাসি না ফুটতো আজ, তবে মিছে মঙ্গল কলস হোত তার। মনে পড়লো, গাড়ীতে বসে মহীন আর মাধুরীর, দু’পয়সার বার্লি কিনতে এসে ছিল একটি মেয়ে, মেসই সুত্রপাত মহীন যদি একবার এসে দেখতো এইসব।
না, মহীনের এসে কাজ নেই, বিয়ে, বৌ, ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে আছে, তাকে তার অশক্ত দুর্বল শরীর সেবা যত্নে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠেছে, পল্লী বধুর নিপূণ পরিচর্যায় হয়তো মোটা হয়ে উঠেছে। মাধুরী ভাবতে লাগলো, তার চিঠি খানা আজ পাবে, পেয়ে কি ভাববে মহীন। নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে মাধুরীর অন্তরে সে অক্ষয়, তার স্বাক্ষর তেমনি উজ্জ্বল আছে, কিন্তু তার পল্লীবধু দেখে যদি চিঠিগুলো কি ভাববে? নিশ্চয়ই সে মাধুরীকে শত্রু ভাববে । মাধুরী তার মঙ্গলই কামনা করে ।
দশ বছরে দশখানা চিঠি লিখেছে মাধুরী। মহীনের বাঁধানো ফটোতে নয়টি দাগ রক্তের। আজ আর একটি দেবে, তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে ডান হাতের অনামিকা বিদ্ধ করলো। রক্ত পড়ছে, ফটোতে ফোঁটা দিতে দিতে বললো—
এই একবিন্দু মধু তোমায় দিলাম, রক্ত চোখের জলটা মুছে ফেললো। মাধুরী হাসছে। নিজের সিঁথিতে ঠেকালো আঙ্গুলটা। রক্ত লাগলো। প্রণাম করলো আবার। এই চিহ্নটা ওর এয়োতির। আঙ্গুলটা তুলো দিয়ে বেঁধে নিল, তারপর বেরিয়ে গেল কাজ দেখতে।
বিরাট বিস্তর আয়োজন। স্তুপাকার করা হচ্ছে। জামাকাপড় বিতরণ করা হবে। সদ্যজাত শিশু থেকে বারো বছরের ছেলেমেয়ের জন্যে নানা রকম পোশাক এ পল্লীর দরিদ্র অধিবাসীদের জন্যই। তাদের হিসাব করে টিকিট দেওয়া হয়েছে। ক’খানা লাইন দিয়ে দাড়ালো এসে, বাচ্চারা তাহাদের মার কোলে আলাদা জায়গায়। পাড়ার কোন বয়স্ক বা শ্রদ্ধা ভাজন ব্যক্তি এই পৌরহিত্য করেন, জজ ম্যাজিট্রেট, কাউকে ডাকে না মাধুরী, কিন্তু আরো কাজ আছে। ব্রজধামের বিদ্যার্থীগণ খেলাধুলা দেখাবে, আবৃত্তি করবে গান শোনাবে, ছোট মেয়েরা ফুলের মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা দেখাবে এবং আরো কত কি তার জন্যেও পুরস্কার দেবে মাধুরী। ব্যাপারটা সমারোহের তাই বিস্তর লোক দেখতে আসে।