আহা! কে এই অভাগী। আপন মনে বলে উঠলো অর্পণা। চিঠিতে কোথাও ঠিকানা নাই। নীচের দিকে পুনশ্চ দিয়ে লেখা হয়েছে–
রেকর্ড আর রেডিওতে আমার অরুচি ছিল, ওতে তোমার গান বাজে, তাই ও দুটো আজ আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমার সেতার তোমার হাতে কেমন বাজে শুনতে বড় ইচ্ছে হয়, এ স্বপ্ন কবে সফল হবে মহীনদা?
অর্পণার চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। পিছনে খোকন নিজের হাতে মালা গেঁথে এসে দাঁড়িয়েছে কাকুর ফটোতে পরাবে। প্রশ্ন করলো–
কার চিঠি মা, কি লিখেছে?
আরো বড় হয়ে দেখিস মানিক, অর্পণা খামে ভরে চিঠিখানা সযত্নে তুলে রাখলো সেই কুলুঙ্গীতে, খোকন ফটোতে মালা দিলো প্রণাম করলো।
মহীনের ঘর খুলে ওর মাথার কাছে বসিয়ে দাও অর্পণা। আর সেতারখানা দাও ওকে শোনাতে হবে আজ।
জল তো পড়ছে না দৃষ্টিহীন চোখ। হাসছেন দেবেন্দ্র, অর্পণা একটু ভয় পেল কিন্তু স্বামীকে সে চেনে, বললো,
আজ একখানা চিঠি এসেছে। আবার সেই নীল খাম, লাল কালির ঠিকানা। কে লিখেছে? দেবেন্দ্র প্রশ্ন করলেন।
সেই মাধুরী, ওর ডাক নাম হয়তো মাধু। ওরই হয়তো ঐ সেতারখানা ওটাই বাজাও।
অর্পণা স্বামীকে ধরে এনে বসিয়ে দিল মহেন্দ্রর বিছানায়। হাত তুলে দিল মাধুরীর সেতারখানা। দেবেন্দ্র আধ মিনিট স্তব্ধ থেকে বললেন। সঞ্চিত পাষাণে তাঁর পূজার ইতিহাস, আর বিশুস্ক ফুল বিশ্বদলে তার মাধু বাতা ঋতায়তে মধুক্ষন্তি সিন্ধুর নবুবৎ পার্থিব রাজঃমধু ওঁ মধুওঁ—
প্রতি বিজয়া দশমীর ডাকে আসে ঐ চিঠি, নীল খাম লালকালিতে লেখা নাম। অর্পণ নিঃশব্দে খুঁলে পড়ে, চোখের জলে ভাসে, তারপর রেখে দেয় আলমারীতে। সন্ধ্যায় দেবেন্দ্র বাজান মাধুরীর সেতারখানা। এমনি চলেছে, আট বছরের খোকন ষোল বছরে পড়েছে, ম্যাট্রিক দিচ্ছে এবার, কিন্তু অর্থাভাবে আর পড়া হবে না বোধ হয়। মহেন্দ্রের বই–এর রয়েলটির টাকা বেশি আর নাই, কতদিনই বা আসবে আর! কিন্তু অর্পণার দাদা কলকাতায়। ভালো চাকুরি, করেন, তিনি কতদিনই এসে বললেন ছেলেটাকে তিনি কলকাতায় নিয়ে পড়াবে?
কলকাতায় ছেলে পাঠাতে আমার ইচ্ছে নেই দাদা। কলকাতায় পাঠিয়ে আমি মহীনকে হারিয়েছি, অর্পণা চোখের জল ফেলে বললো।
কলকাতায় না গেলে চলে না অর্পণার দাদা বললো, ওখানে যেতে হয়। যার যার নিয়তি, কলকাতা কি দোষ করলো? ছেলেটাকে দে আমার, মানুষ করি।
সব শুনে দেবেন্দ্র চুপ করে থাকলেন অনেকক্ষণ। খোকনের মামার কথায় বললেন
যাও যেখানে খুশি নিয়ে ওকে মানুষ করতে, আমি যাকে মানুষ করেছিলুম, সে আমার ঘুমিয়ে গেছে, তাকে জাগিয়ে দিও না, নিঃশব্দে নিয়ে যাও, সে যেন জানতে না পারে, এই বংশ আর কারো সাহায্য নিচ্ছে। উঠে চলে গেল অন্যত্র।
অতঃপর মামার সঙ্গে খোকন এল কলকাতায়। মামার নাম অসিত বাবু ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন মধ্য কলকাতা, চাকুরী করেন গভর্ণমেন্ট অফিসে। রোজগার ভালই, তার নিজের ছেলেমেয়ে দুতিনটি। খোকন তাদের সঙ্গেই পড়াশুনা করছে। কলেজেও যাচ্ছে। কিন্তু গরীবের ছেলের পড়ার যে কত অসুবিধা, তা ভুক্তভোগীই জানে, সব বই কেনা হয়নি, মাইনেও সব মাসে যথাকালে দেওয়া হয় না, তাছাড়া কলেজের কত রকম আগডুম বাগডুম, চাঁদা তো লেগেই আছে। তবু খোকন পড়া চালিয়ে যাচ্ছে তাকে মানুষ হতে হবে। গানবাজনাও ভাল শিখেছে। দু’একটা আসরে গায় এমন করে নিজের একটু ঠাই করে নিল সঙ্গীত মহলে। কিছু রোজগারও হচ্ছে।
পূজার বন্ধে বাড়ী এল খোকন। সেই বিজয়া দশমী, সেই নীল খাম অর্পণা খুলে পড়ে রেখে দিচ্ছে। খোকন বললো–
এবার বড় হয়েছি মা দাও চিঠিগুলো পড়ে দেখি।
না খোকন, ও কি দেখবি।
দেখতেই হবে, দেখার জন্যে কাকু আমার রেখে গেছে। ঝর ঝর জল ওর চোখে। ন’খানা চিঠি সবশুদ্ধ, সবগুলোই সালের পর সাল ঠিক করে সাজিয়ে পড়লো, কোনটায় ঠিকানা নাই। অতি ভদ্ৰভাষায় অতি সংক্ষিপ্ত চিঠি। কিন্তু প্রতি অক্ষরে অন্তর নিংড়ে লেখিকা নিজেকে সমর্পণ করেছে কাকুর কাছে। কল্পনা প্রবণ কবি খোকন বেশ বুঝতে পারল, এই মাধুরী কাকুর প্রিয়তমা। সযত্নে চিঠিগুলি আবার সাজিয়ে রেখে দিল ঠিক করলো যেই হোন মাধুরী তাকে খুঁজে খোকন বের করবে। শেষের চিঠিখানায় সামান্য ইঙ্গিত রয়েছে–
ব্রজধামে আভীর, নারী গোপ–বালক এবং ধেনুদলের অভাব নেই, নেই শুধু রাখালরাজ কৃষ্ণ। কিন্তু বৃন্দাবনে নিত্য প্রেম তাকে আবার আনবেই ফিরিয়ে।
কলকাতায় ফিরলো খোকন। কাকুর প্রিয়তমার খোঁজ করতেই হবে, দেখা করতে হবে। তার সঙ্গে। অবসর সময় পরে কাজ হলো ওর প্রতি বাড়ির নাম খুঁজে ফেরা। বড় বড় রাস্তা খেকে গলি পর্যন্ত নেম প্লেট দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে, না ব্রজধাম নয়। তবু নিরাশ হয় না খোকন। সংকল্প, খুঁজে বার করতেই হবে ব্রজধাম তার কাকুর প্রিয়তমার নিবাস।
বিজয়া দশমী আসছে। প্রতি বছর এই দিনে উৎসব হয় ব্রজধামে। এ দিনেই মাধুরীর জীবনের এক পরম দিন। এ দিনই মহীন এসেছিল তাদের বাড়ীতে আজ মহীনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পেরেছে মাধুরী। গরীব দুঃখী কাঙ্গালদের মুখে হাসি ফোঁটানের কাজে অনেকটা সফল হয়েছে সে। বিরাট আয়োজন চলছে এদিনের জন্য। ব্যবস্থা করা হয়েছে। গরীব ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় বিতরণের, রোগীও শিশুদের দুগ্ধ দেওয়ার।