খান পাঁচেক দিন আমার, মাধুরী বললো।
আপনার কি কেউ হন উনি? দোকানদার অকস্মাৎ প্রশ্ন করলো বইগুলো হাতেই।
না, হ্যাঁ, আমার– মাধুরীর মুখে হাসি, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
পাঁচ টাকা বইয়ের। টাকা পাঁচটা দিয়েই মাধুরী চলে গেল ক্যাশ মেমো নেবার জন্যে অপেক্ষা করলো না।
বইগুলো অতি যত্নে বাধলো একটা তোয়ালে দিয়ে। পড়বে, পড়ে দেখবে তার ‘মরণ যমুনা’ কোথায় কেমন সে। মাধুরীই কি ‘মরণ যমুনা’ নাকি। দূর। মাধুরী ছেড়ে হাওয়ার জন্যেই ঐ নাম দিয়েছে মাধুরী যেন বুঝতে না পারে। অম্লান হাসি ওর মুখে, অমলিন ওর হৃদয়, ভাবলো বিয়ে না হলে কি বাঁচে না মানুষ? খুব বাঁচে, আরো ভালভাবে বাঁচে। এই যে স্মৃতি অমৃত, এই যে আলো স্পর্শ এ কি তুচ্ছ, মুল্যহীন।
গ্রামোফোনের দোকানে এলো মাধুরী, নামলো গাড়ি থেকে। চেনা দোকানী আসুন আসুন বলে অভ্যর্থনা করলো। মাধুরী গিয়ে বসতে বসতে বললো–
মহীনদার, মহীন মুখুজ্যের কি রেকর্ড বেরিয়েছে দিন।
অসম্ভব সেল ওর খান তিনেক মাত্র আছে আর বলে দোকানী রেকর্ড বের করে বললো, বাজিয়ে দিই?
হ্যাঁ বাজান, দেখে নিই ঠিক আছে কিনা।
দোকানদার রেকর্ড চালিয়ে দিল গ্রামোফোনে শুনছে। মাধুরী শুনছে তন্ময় হয়ে। কোথায় আছে মাধুরী? মাটিতে না আকাশে ও জানে না কলকাতা শহরের দোকান, অজস্র লোক, অসংখ্যা শ্রোতা এবং খরিদ্দার, সবাই দেখছে–নির্বাক নিস্পন্দ মাধুরী বসে আছে ঠিক পাথরের মূর্তির মত। দুই চোখের কোল বেয়ে দুটি ধারা নেমে এসেছে, একি সুখ। একি বেদনার অমৃত মন্থন।
অকস্মাৎ সিন্ধুলব্ধ মাধুরী রেকর্ড কয়খানা বাক্সে ভরে সটান দমদমার বাগানে চলে গেল বুকটা তখন ফুলে উঠেছে কি এক আনন্দ বেদনায়।
সারা বাড়ীটা কেমন যেন নিঝুম হয়ে গেছে, কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না, মনেই হয় না যে ওখানে মানুষ আছে, যেন বহু প্রাচীন একটা সামাধিস্তূপ।
সকালে খোকন হাত মুখ ধুয়ে বাগানে ফুল তুলে আঁচল ভর্তি করে, তারপর নিঃশব্দে এসে জানালা গলিয়ে ছড়িয়ে দেয় মহেন্দ্রের বিছানার উপর। বিছানায় মহেন্দ্রের ফটো আর সেই সেতারখানা, সাজানো আছে। কুঠুরীর দরজায় একটা প্রকান্ড তালা, খোকন ঢুকতে পারে না। বন্ধ দরজার সম্মুখে হেঁট হয়ে প্রণাম করে, চোখে জল আসে ওর মুছে নিঃশব্দে পড়তে বসে গিয়ে।
তারপর সমস্ত দিন নিঝুম বাড়ীখানা, বাইরে দেবেন্দ্র তার চৌকিতে শুয়ে বসে ভেতরে অর্পণা নীরবে গৃহকাজে রত, স্কুল থেকে ফিরে খোকন নীরবেই কিছু জল যোগ করে তারপর বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় আসে সঙ্গীত সাধকের দল ঐ সময়টা একটু যা লোকসমাগম বোঝ যায়, কিন্তু এতো সাবধান যেন এখনি ঘুম ভেঙে যাবে এমনি ভয়ে ভয়ে। টোলের ছাত্রগুলি আছে কিন্তু তারা জানতেই চায় না যে, তারা আছে এমনি নিঃশব্দে তারা পাঠ অভ্যাস করে। শ্মশানের স্তব্ধতা যেন জেগে আছে বাড়িখানায় অহরহ।
কিন্তু তথাপি দিন চলে যাচ্ছে, মাস গেল, বৎসর পূর্ণ হতে চলল। আবার সেই বিজয়া দশমী। এর মধ্যে মহেন্দ্রর প্রথম উপন্যাস মরণ যমুনার প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে, অন্য বই দুটিও ভালো বিক্রি হয়েছে। বেশ কিছু টাকা দিয়ে আবার ছাপার স্বত্বঃ কিনে নিয়ে গেছেন পাবলিশার্স। দেবেন্দ্র কথাও কইলেন না। শুধু সই করে দিলেন খোকনের অভিভাবক হিসাবে। টাকাও ছুলেন না তিনি।
মরণের পরেও তার খোকনের জন্য রোজগার করেছে, অর্পণা কেঁদে ভাসালো টাকাটাকে।
অন্ধ তাই দেখি না, কানটাও গেলে ভাল হতো অর্পণা, এসব শুনতে পেতাম না।
নিঃশব্দে অর্পণা টাকাগুলো নিয়ে ভেতরে গেল। দেবেন্দ্র সহ্য করতে পারেন না এই অর্থাগম। মহীন নেই, তার টাকা আসে। মহীনের অর্জিত এ যে ওঁর বুকে কতবড় বজ্র জানেন তিনিই। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ থেকে বললেন বুকখানা তো ফেটে যাচ্ছে।
শুনতে পায় অর্পণা। গড় গড় করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। অভাগী নারী অশ্রু সম্বল করে বেঁচে আছে শুধু খোকনের মুখ চেয়ে। সন্ধ্যায় ধুপ ধাপ জ্বেলে দিতে আসে মহেন্দ্রের ঘরখানায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে বিছানার কাছে তারপর তালা দিয়ে চলে যায়।
আজ আবার বিজয়া দশমী, ঘরখানা ভালো করে পরিস্কার করলো অর্পণা। বিছানাটা ঝেড়ে পাতলো ফটোটি সযত্নে মুছে রাখলো, সেতারটি ঝেড়ে মুছে আবার রেখে দিচ্ছে। সাগর পিওন এসে বললো, চিঠি বৌদি ঠাকুরণ।
দাও, অর্পণা হাতে করে নিল। সাগর, নীল রংগের খাম আর সেই রং এর কাগজ উজ্জ্বল লাল কালিতে লেখা ঠিকানা, যেন বুকের রক্ত দিয়ে লিখেছে নামটা শ্ৰীযুক্ত মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
অতি সাবধানে পড়লো যেন খামটা নষ্ট না হয় এমনি ভাবে চিঠিটা খুলল অর্পণা। পড়লো–শ্রীচরণেষু
আজ আবার বিজয়া দশমী মহীনদা, সারা বছরের প্রণাম গ্রহণ কর। যত দূরেই থাক, তোমার সঙ্গ আমি সর্বক্ষণ পাই, সঙ্গীতে সঙ্গীতে আর তোমার দেওয়া কাজে। সে কাজ এত সুন্দর মহান, তা জানতাম না।
জীবন শুধু সুন্দর নয় মহীনদা, সে জীবন মহীময়, কিন্তু সে জীবন হবে তপঃ ক্লিষ্ট ঋষির জীবন, কর্মময় ত্যাগের জীবন। তোমার প্রেমের বলে আমি জৈব জীবনের গণ্ডী পার হয়ে যেতে পারবো মহীনদা, ভয় নাই।
দাদা বৌদিকে আমার অনন্ত প্রণাম আর খোকনকে অন্তরের শুভাশীষ জানালাম।
তোমাকে কি জানাবো ভেবে পাচ্ছি না, সবই জানালাম, প্রণাম নমস্কার প্রীতি, ভালবাসা।
ইতি–মধু।