না না এসব কিছু না হয়তো তোমার পল্লীবধু নিয়ে রাত জাগছো বাড়িতে তাই আমার মালা নিতে চাইছ না, কিন্তু আমি তো ব্যাঘাত করিনি, বাধা দিইনি আমার গোপন পূজা গোপনেই থাকবে। মালাটা পরিয়ে দিল মাধুরী ধুপ জ্বেলে দিল তারপর প্রণাম করলো গলায় আঁচল দিয়ে।
রাত অনেক হয়ে গিয়েছে ঘড়িটা দেখলো একবার, কিন্তু এখনো কিছু কাজ বাকি। গ্রামোফোনটা খুললো মাধুরী, দম দিল তারপর একখানা নতুন বোর্ড ভাল করে মুছে চোখ। বুজে বললো মনে মনে, তোমার গাওয়া গান শুনতে শুনতে আজ ঘুমোব–বড় ঘুম। পেয়েছে।
রের্কড খানায় পিন লাগিয়েই মাধুরী শুয়ে পড়লো পালঙ্কে। সুর ছড়িয়ে পড়ছে–গড়িয়ে পড়ছে যেন, আকাশচুম্বী পাহাড় থেকে অলকানন্দ ঝরছে মিষ্টি হাসি ফুটলো ওর মুখে নীল আলোটা জ্বেলে দিয়েছে। রেকর্ড বাজছে। অকস্মাৎ কড় কড় আওয়াজ। হলো কি? মাধুরী ত্বরিত উঠে আলো জেলে দেখলো থেমে গেছে মেশিনটা। এ রকম তো হয় না? রেকর্ড খানা হাতে তুলতেই দু’খানা হয়ে গেল। মাধুরীর দুচোখ দিয়ে জল ঝরে পড়লো–না কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না আর। বার বার এমন অমঙ্গল কেন? অন্তর জুড়ে এই প্রশ্ন জাগলো।
সারা রাত কিভাবে কাটলো, জানে না মাধুরী, ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল মার্বেলের মেঝেতে, ঘুম ভাঙল মেজদির আহবানে। তাড়াতাড়ি উঠে আলোটা নেভালো, ফটোখানা লুকিয়ে ফেললো এবং ভাঙা রেকর্ডটা আলমারীর তলায় ভরে দিল তারপর দরজা খুলে বললো কি বৌদি?
আজ আমাদের স্টীমার পার্টি আর তুই এখানে ঘুমুচ্ছিস। যাবি বলেছিলি যে?
বৌদি, আমার যাওয়া হবে না। অনেক কাজ পড়ে আছে বজ্রধামে এখুনি বেরুতে হবে। কাল রাত্রে ফিরতে অনেক দেরী হয়েছিল আমার।
কুমার বরুণবাবু তাছাড়া আরো অনেকে যাচ্ছেন। ওস্তাদ হিমায়েত খাঁও আসবেন। তুই না গেলে সব ফাঁকা লাগবে ছোটনি চল।
না বৌদি মাফ চাচ্ছি। মাধুরী স্নান করার জন্য চলে যাচ্ছে।
সোসাইটি তুই ছেড়ে দিলি মাধু? মেজবৌদি করুণ স্বরে বললো আবার।
হ্যাঁ, ও সোসাইটি ছেড়েছি, অতকম জলে আমার মত মাছ খেলতে পারে না, বাংলার যে বিরাট বিস্তার সমাজ, সেখানে আমার ঠাঁই করে নিতে চাই। তাদের দুঃখ দৈন্য আনন্দ বিলাসের অগাধ জলে সাঁতরে বেড়াবো বৌদি, তোমার ইঙ্গ বঙ্গ সোসাইটিতে আমার পোষাবে না হাসলে মাধুরী।
ওঁরা সবাই আশা করে আছেন।
ওদের জানিও, গঙ্গাকে ঐরাবত আটকাতে পারে না, হোক না সে ইন্দ্রের বাহন, গঙ্গা সাগরে পড়বেই সাত কোটি সন্তানকে উদ্ধার করতে হবে তার। চলে গেল মাধুরী বাথরুমে। মেজবৌ তবু আধ মিনিট থেকে দেখলো ওর ঘরখানা খোলা গ্রামোফোনটা গলায় ছেঁড়া মালা, পুড়ে যাওয়া ধুপ কিন্তু কৈ?
কোথাও মহেন্দ্রের স্মৃতিচিহ্ন নেই তো? না মহেন্দ্র এখানে কি জন্য আসবে। মাধুরীর মনের মত কেউ এখানে আসেনি তাই মেয়েটা এরকম করছে কিন্তু সমাজে যদি না বেরোয় তো মনের মত বর জুটবে কি করে। মেজদা বলছে মাধুরীকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে, কিন্তু যা মেয়ে। ও কি যাবে। স্নান সেরে বেরুক, আরেকবার বলবে মেজবৌ ভেবে চলে গেল।
মাধুরী বেরুলো বাথরুম থেকে। মনটা খুব হাল্কা হয়ে গেছে। গত রাত্রের ব্যাপারগুলো কিছু নয় ও নিয়ে মন খারাপ করবার কিছুই নাই মা পূজার ঘরে গিয়ে প্রণাম করলো ঠাকুরকে তারপর চা খেল বাবার সঙ্গে উমেশবাবু প্রশ্ন করলেন। তুই যাবিনে ওদের পার্টিতে।
না বাবা ওতে আমি আনন্দ পাইনে।
কেন মা? সবাই খাবি দাবি, গান গল্প করবি, বেশ তো ব্যাপার।
ওতে মন শুধু ভোগের দিকে থাকে বাবা, ভাবের দিকে যায় না, এগুলো এতো বহির্মুখো যে নিজেকে খুঁজতে আবার নির্জনে গিয়ে বাসা নিতে হয়।
উমেশবাবু জানেন তাঁর এই মেয়েটির অসাধারণত্ব, চিন্তায় এবং কাজে সে চিরদিনই স্বতন্ত্র এবং এই জন্য তার ভয়, আর পাঁচটা মেয়ের মত নয় মাধুরী হলে ভাল হতো, কিন্তু হয়নি এখন যখন উপায় কি? তবু হেসে বললেন তোরা ছেলেমানুষ এখন তো বাইরে খেলাধুলা নিয়েই থাকা উচিত।
খেলাধুলাকে উল্টে দাও, ধুলাখেলা হয়ে যাবে, ওগুলো সব খেলাধুলা গায়ে দাগ লাগে, মনকে বিরক্ত করে হাসলো মাধুরী, বললো মানুষ ততক্ষণ ছেলে মানুষ থাকে বাবা যতক্ষণ সে জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না, দু’পাঁচ বছরের জীবনের উদ্দেশ্যে বুঝেছিলেন, ঈশ্বর লাভ তিনি তখনি করেছিলেন আর ছেলেমানুষ ছিলেন বুঝলেন বাবা?
হ্যাঁ মা, করুণ হাসলেন উমেশবাবু।
তুমি আমার সব থেকে ভাল ছাত্র বাবা বলে উঠে চলে গেল।
এরপর গাড়িতে চড়ে বেরুলো মাধুরী বাজারে যাবে রেকর্ড ভেঙ্গে গেছে সেটা কিনতে হবে ওকে। দু’পাশে সারি সারি দোকান সাজানো, পূজার বাজারের ভিড় তখনো রয়েছে, দেখছে মাধুরী গাড়িতে বসে, বড় বড় পোষ্টার মারা রয়েছে দেয়ালে।
মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অমর উপন্যাস, ‘মরণ যমুনা’ বের হলো।
একখানা বইয়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মাধুরী দোকানীকে বললো–‘মরণ যমুনা’ আছে? দিন একখানা।
দোকানদার দিল বই খানা ওর হাতে এনে। চমৎকার বাঁধানো বই, খুলেই দেখতে পেল উৎসর্গ পত্রটা শ্রীমতি মাধুরী করকমলেষু–
বুকে ঠেকালো বইখানা মাধুরী, প্রশ্ন করলো দোকানদারকে আবার– বইটা কেমন হয়েছে? কি রকম বিক্রি হচ্ছে–
অসাধারণ বই রেকর্ড সেল যাচ্ছে।