নীরবে চিঠিখানা বুকের উপর রাখলো মহেন্দ্র রেখে চোখ বুজলো। জল আসছে চোখে ওর কিন্তু সামলাচ্ছে। অকস্মাৎ অর্পণা এসে ঢুকলো। ভাবলো হয়তো ঘুমাচ্ছে মহীন।
নীরবে অর্পণা বুক থেকে চিঠিখানা তুলে নিল। আধা মিনিটে পড়ে ফেললো কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। কে মাধুরী চেয়ে দেখলে মহেন্দ্র ঘুমায়নি, জেগে রয়েছে। বলল কে মেয়েটি?
ওর কথা আজ থাক বৌদি সেতার দাও একবার।
চিঠির জবাব?
না দিতে হবে না, চিঠিখানা ঐ কুলুঙ্গীতে রেখে দাও বৌদি মহেন্দ্র উদগত অশ্রুতে ভেঙ্গে পড়ছে বারবার, অর্পনা সবই বুঝল বলল–
সে অভাগী তোমার অসুখের কথা জানে না মহীন।
না না জানানো চলবে না বৌদি, তাকে কিছুতেই জানাতে হবে না।
কুমারী মেয়ে সে ভুলে যাক মহীনকে। চিঠিখানা ঐখানে রেখে দাও। যেন আমি শুয়ে শুয়ে দেখতে পাই বৌদি।
মহীন। উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে উঠলো অৰ্পণা। দুর্ভাগী অর্পণা সন্তান স্নেহে মানুষ করেছে মহীনকে, খোকনের চেয়ে মহীন তার কাছে এতটুকু কম নয়, কিন্তু মানুষের কিছুই করবার নাই। নিজেকে সামলে যত্ন করে রেখে দিল চিঠিখানা খামের ভিতর ঐ কুলঙ্গীতে মহীনের শয্যার বা দিকে।
মহেন্দ্র অতিকণ্ঠে আঙ্গুল বুলিয়ে চলেছে সেতারে সন্ধ্যা আসন্ন।
বিসর্জনের বাদ্য কোলাহল, প্রতিমার গ্রাম পরিক্রমণ এবং বিসর্জন শেষ হলো। মহেন্দ্র তখনো বাজাচ্ছে সেতার। কি মধুর ঝঙ্কার, কি করুণ সে রাগিনী। বিশ্বমার বিরহে যেন ধরিত্রী গুমরে উঠছে। অকস্মাৎ খোকনকে নিয়ে অর্পণা এল। খোকন প্রণাম করবে কাকুকে।
ওকে কেন আনলে বৌদি এখানে?
তা হোক। বড় কাঁদছিল। তোমার অত ভাবতে হবে না, নে প্রণাম কর।
খোকন প্রণাম করে নির্নিমেষ চেয়ে রইল কাকুর পানে যেন চেনাই যায় না। কিন্তু কাকু বললো আস্তে
বেঁচে থাক, এই বংশের গৌরব হয়ে বেঁচে থাক মানিক
কিন্তু খোকনকে ওর বুকে নিতে পারল না, জড়িয়ে ধরলো না, এ যে কত বড় দুঃখ তা জানে ওর অন্ত র্যামী। অসহ্য বেদনায় মহেন্দ্র উঃ বলে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।
খোকন আস্তে ডাক দিল কাকু। মহেন্দ্র শুধু চাইল, কথা বলতে পারল না।
ক্লান্তিতে সর্বাঙ্গ অবসন্ন ওর। অর্পণা খোকনকে সরিরে দেখলো মহীন নির্জীব ক্ষীণ হয়ে আসছে। ও ঘরে দেবেন্দ্রকে জানালো গিয়ে, দেবেন্দ্র উঠে এসে দেখলেন নাড়ি–তারপর। নিঃশব্দে ও ঘরে ফিরে গেলেন মহীনের কোল থেকে সেতারখানা নিয়ে। শোন মহীন–ও ঘর থেকেই বললেন এবং আরম্ভ করলেন বাজাতে। ওঃ। মানুষ যে এমন পাথর গলান সুর জাগাতে পারে, জানতো না কেউ। বিজয়ার প্রনাম করতে আসছে গ্রামবাসিগণ সবাই স্তব্ধ। দাঁড়িয়ে গেছে। ভেতরের ঘরে মৃত্যু পথযাত্রী মহীন–কাছে একা অর্পণা আর বাইরের ঘরে দেবেন্দ্র সেতার বাজাচ্ছেন চোখে জল ভেসে আসছে। মধ্যরাত্রির মহা নীরবতা বিদীর্ণ করে বেজে চলেছে সুরলহরী তরংগে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোন এক অশরীরী আত্মাকে কোন দ্যুলোকের পথে কে জানে।
মহীন? অর্পণা আর্ত কণ্ঠে ডেকেই চুপ হয়ে গেল। আর ঐ আর্তকণ্ঠের আঘাতেই যেন সুর সাধক দেবেন্দ্রের হাতের সেতারটার একটা তার ছিঁড়ে যন্ত্রটা ও আর্তনাধ করে উঠলো। মহীন নাই। ও ঘর অর্পণা মূৰ্ছিতা হয়ে পড়েছে আর এ ঘরে দেবেন্দ্র নিঃশব্দে বসে রইলেন ছেঁড়া সেতারটা হাতে নিয়ে। তখন সুরের পরীরা যেন নৃত্য করে বেড়াচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে ক্রন্দন ধ্বনি তুলে কেউ এই সমাধি মন্দিরকে বিচলিত করতে সাহস করলো না। খোকনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি–সে বাইরে দাঁড়িয়ে তুলসী তলার প্রদীপটার বুক জ্বলছে–অমঙ্গল হয়। জলভরা চোখে দেখেছে খোকন অকস্মাৎ দমকা হাওয়ায় প্রদীপটা নিবে গেল–অন্ধকারে খোকন একা।
নানা কাজে ব্যস্ত মাধুরী সমস্ত দিন। আজ বিজয়া দশমী। কাজের মধ্যে যতবার মনে হচ্ছে মহীন এতক্ষণ চিঠিখানা পেয়েছে, ততবারই ওর মুখখানা হাসি মাখা হয়ে উঠেছে। চিঠিতে যদিও কিছু নাই, তবু কত যে আছে ওর অন্তরের সৌরভ।
সকাল থেকে আজ বিনামুল্যে ফুল আর দুধ বিতরণ করছে ও পাড়ায় ছেলেমেয়েদের আর একটু করে মিঠাই। গরু। ছাগলগুলোকে নিজের হাতে কাঁচা ঘাস খাইয়েছে। কর্মচারীদের বকশিস দিয়েছে। ওপাড়ার পূজা মণ্ডপে পাঠিয়েছে ওর প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুত ননী ক্ষীর। রাত দশটা পর্যন্ত সব শেষ। বিসর্জন দেখতে দেখতে শ্যামবাজারে বাড়িতে ফিরছে মাধুরী।
সারা মনখানি জুড়ে কেমন একটা বিশেষ আনন্দানুভূতি আজ যেন জেগে আছে, আঁচলে আছে একরাশ ফুল ওর বাগানের ফুল। নিজের হাতে একটা মালা গাঁথতে গেটে ঢুকার সময় একটু লাফিয়ে উঠতেই। আংগুলে সূচ ফুটে গের, উঃ। অব্যক্ত শব্দ করে উঠলো মাধুরা। বাড়িতে ঢুকলো। গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে যাচ্ছে আঁচলের ‘সাক্ষী’ ফুলগুলি তুলে নিয়ে
সটান ওপরে চলে গেল। ওখানেই খেয়েছে তাই বড় বৌদিকে ডাক দিয়ে জানিয়ে দিল যে, খাবে না।
নিজের ঘরে এসে মাধুরী দরজা বন্ধ করলো দেরাজ টেনে মহীনের ফটোখানা বের করলো অত্যন্ত গোপনে এ ফটো সে রাখে, তাই বাঁধানো হয়নি টিপয়ে সেটা সাজিয়ে নিজের গলার মালা তাকে পরাতে গিয়ে মাধুরী দেখতে পেল–সুচ ফোঁটা আংগুলে কখন একবিন্দু। রক্ত এসেছিল, তাই লেগে গেছে ফটোর বুকেঃ সাদা পাঞ্জাবী পরা বুকখানা দাগি হয়ে গেছে।
কেন এমন হচ্ছে? বার বার কেন হচ্ছে এরকম? মাধুরী নিমিষে চোখে রক্তের দাগটা দেখতে দেখতে ভাবলো–আঁচল দিয়ে মুছবার চেষ্ট করলো। সে আধুনিক সমাজের শহুরে মেয়ে কোন কুসংস্কার ওকে আচ্ছন্ন করে না, তবু যেন কি এক অমঙ্গল আশংকায় মলিন হয়ে। উঠলো মাধুরী কিন্তু তখনি দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে ফটোটাকে লক্ষ্য করে আপন মনে।