গভীর রাত্রি, রেলগাড়ি ঝমঝম শব্দে দৌড়াচ্ছে, মহেন্দ্র এক কোণায় সেতারের অবগুণ্ঠন। উন্মোচন করলো। ঝলঝল করেছে যন্ত্রটা যেন স্বাস্থ্যোজ্জ্বলা অপরূপা মাধুরী বধু বেশী বাসর সঙ্গিনী মাধুরী। আস্তে আস্তে হাত বুলালো মহেন্দ্র ওর গায়ে একবার, তারপর আঙ্গুল চালালো, রাত্রির অন্ধকার বিদীর্ণ করে সে সুর ঝঙ্কার হয়তো মাধুরীর মনে পৌঁছাবে। মুখে অমলিন হাসি ফুটে উঠলো মহেন্দ্রের।
কাকু আসবে তবু মা এতা কাঁদছে কেন? ভেবে পাচ্ছে না ছেলেটা। কী হলো। বাবাই কেন দাঁড়িয়ে ওখানে। কিন্তু বাবার চোখে তো জল নেই? তানপুরা সেতার মৃদঙ্গ বাঁশীর মাঝে বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে। খোকন আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে হলো কি? অকস্মাৎ দেখতে পেল বাবা বলছে–
এবার ঘুমাও হে ক্রুদ্ধ শিল্পী এবার এই হতভাগ্য বংশকে মার্জনা কর আমার শেষ সম্বল কেড়ে নিও না, বাবার মাথাটা লুটিয়ে পড়লো মৃতঙ্গের উপর। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। খোকন। কাকুর ঘর পরিষ্কার করছে মা, কাকু থাকবে। পরিষ্কার তো করাই উচিত। খোকন। নিজেও গেল, কিন্তু মা অবিরত কাঁদছে। বললো খোকন না বৌদি এই সেতারটি ওকে ভোলবার জন্য।
খুব দামী সেতার না?
হ্যাঁ বৌদি, আমার জীবনটার দাম বলে হাসে মহীন নিঃশব্দে। থাক ভাই বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
আর কদিন বাঁচবো। বৌদি হাসে মহেন্দ্র সকরুণ হাসি আবার। অর্পণা নির্বিঘ্নে কেঁদে চলে যায় অন্যত্র।
তৃতীয় উপন্যাসখানও শেষ করে পাঠিয়ে দিল মহেন্দ্র প্রকাশককে। বিশ্বাসী প্রকাশক ওর নাম করেছে, তাই দ্বিতীয় তৃতীয় খানার জন্য ভালই রয়েলটি পাবে মহেন্দ্র।
খোকনকে কিন্তু কেই ঢুকতে দেয় না এ ঘরটায়। কাকুর অসুখ খোকন কাছে এসে দেখতে পায় না কাকুই বারণ করে। কেন? কাকু তো অমন ছিলো না। বাইরে বাইরে ঘোরে আর কাঁদে খোকন। নিশ্চুপ বসে থাকে পুকুর পাড়ে নয়তো শিউলী গাছটার তলায়।
৮. পূজা এসে পড়লো
পূজা এসে পড়লো। বাংলার আকাশ আনন্দের আর গানে পরিপূর্ণ, শুধু দেবেন্দ্রের ভাঙ্গা বাড়িখানা প্রতীক্ষা করছে মৃত্যুর। দিন দিন অবসন্ন হয়ে আসছে মহেন্দ্র, শেষ হয়ে আসছে আয়ু দীপ। প্রথম উপন্যাস ছাপা হয়ে এসেছে অনেকদিন দ্বিতীয়টাও এল সপ্তমীর দিন নাগাদ, তার সঙ্গে কয়েকটা সমালোচনা আর বেশ কিছু টাকাও। কিন্তু দেবেন্দ্র নোটের বাণ্ডিলটা হাতে নিতে পারলেন না। তৃতীয় উপন্যাসখানাও শীঘ্র বেরিয়ে যাবে। ব্যাস। মহেন্দ্রের সাহিত্য জীবনের ইতি। কে জানে বাংলার পাঠকের অন্তরে কোন গ্রন্থাগারের বইয়ের তাকে কোন পুস্তকের দোকানে সে বেঁচে আছে দেখবার জন্য মহেন্দ্র কিছু মাত্র মাথাব্যথা থাকবে না, তাকে ভুলে গেলেই ভালো। মানুষ আরো উন্নততর সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে যা মহেন্দ্র করতে পারল না। শেষ বইয়ের নাম দিয়েছে ক্রন্দসী। অসীম আকাশ জুড়ে তার পটভূমি আলো জগতের নায়ক নায়িকা কে জানে, ওটা পড়ে কি ভাববে মাধুরী?
মাধুরী নিশ্চয় পড়বে, কিন্তু উপায় কি? পড়ে কিন্তু কিছুই বুঝবে না, কিছুই জানবে না মহেন্দ্র সম্বন্ধে। মহেন্দ্র এ জীবনে আর তাকে বিড়ম্বিত করতে যাবে না, হয়ত জন্মান্তরেও না। মাধুরী যেখানকার, সেখানেই থাক। আকাশের চাঁদকে মাটিতে নামাবার সাধনা শুধু নির্বুদ্ধিতা নয় অন্যায়। তাতে গোটা পৃথিবীকে চাঁদের আলো থেকে বঞ্চিত করা হয়।
আজ বিজয়া দশমী। কত স্মৃতি বুক জুড়ে জাগছে মহেন্দ্রের। রাত্রিতে গঙ্গার কুলের উপর রাত কাটানো, পার্কে বসে খিচুড়ি খাওয়া, তারপর উমেশবাবুর বাড়িতে মাধুরীর দেখা, না এসব ভেবে লাভ নেই।
চিঠি আছে বাবু, বলে সাগর পিয়ন একখানা খাম দিল তার খাটে ছুঁড়ে। নীল রং এর খাম কোথাও ফিকে, কোথাও গাঢ় নীল বর্ণ সুন্দর। খুলে ভিতরে ঐ একই রং এর কাগজ বেরুলো সুন্দর হস্তাক্ষর, মাধুরী লিখেছে, প্রিয় কিন্তু শব্দটা লিখেই এমন কেটেছে যে, পড়া যায়। কাগজটা বদলে দিলেই পারতে ইচ্ছে করে বদলায়নি, অতঃপর ওর নীচে লিখেছে।
শ্রীচরণেষু,
আজ বিজয়া দশমী, তুমি এসেছিলে এই পূণ্য দিনে, আজ তোমাকে প্রণাম না জানিয়ে পারলাম না মহীনদা। জানি তুমি যেখানে থাক, তোমাকে খোকনের স্নেহে তোমাকে টেনে আনবে অন্ততঃ এই দিন তোমার বাড়িতে, তাই বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দিলাম আশা করি যথাসময়ে পাবে।
অকস্মাৎ অতর্কিত ভাবে তোমার চলে যাওয়ার পিছনে যাই থাক আমি অনুসন্ধান করবো পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের বন্ধন রজ্জুটা চোখে দেখা না গেলেও ওদের প্রেমের সত্যটা মলিন হয় না মহীনদা। সূর্যের কত তাপ আছে আর সূর্য কত দূরে আছে, পৃথিবী নাইবা জানলো ওর আলোতে উত্তাপে তো পৃথিবী ফলে ফুলে জীবনে পরিপূর্ণ হচ্ছে, এই কি যথেষ্ট নয়?
দাদা বৌদিকে বিজয়ার সহস্র প্রণাম জানাই। ইতি তোমার মাধু–
লিখেই তোমার মাধু কথাটা কেটে নীচে লিখেছে প্রণেতা মাধু অথচ অনায়াসে কাগজখানা বদলে এই কটা লাইন আমার জন্য কাগজে লিখে পাঠাতে পারতো। কেন সেটা। করেনি, জানে মহেন্দ্র। ছেলেমানুষী। না তার অন্তর।
স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে যা কিছু লিখেছে, তাকে নষ্ট করেনি মাধুরী শুধু ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু কোনো ঠিকানা নাই চিঠিতে। ঠিকানা অবশ্য জানে মহেন্দ্র কিন্তু জেনে কি হবে। এ চিঠির জবাব দেওয়া হবে না।