নেমে এসে দেখতে পেল, কোণের দিকে একটি বুদ্ধমূর্তি। এই বাগানেই বড়দা ওকে এনে বসিয়ে দিয়েছে সুন্দর মূর্তি। মাধুরী এগিয়ে এসে দেখলো পদ্মের উপরে পদ্মাসনে। আসীন ভগবান বোধিস্বত্ব। মনে পড়লো মানুষের কল্যানের জন্যে পত্নী পরিত্যাগ করে ওর মহা তপস্যা বন্ধুত্ব লাভ কিন্তু রাজবধু যশোরা। অভাগী গোপা। মাধুরী নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো মূর্তিটার কাছে কথাগুলো ভাবলো অকস্মাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মূর্তিটাকে দুহাতে জড়িয়ে, মাথাটা লুটিয়ে পড়লো ওর পায়ের উপর। সাদা মার্বেল ছোখের জলে চকচকে হয়ে যাচ্ছে চমকে উঠছে যেন। নিজেকে বিশ্লেষণ করার আর সময় নাই, যে সত্য পৃথিবীর কাউকে জানাতে চায়নি মহেন্দ্র তাকে আর আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়, নিষ্ঠুর রাক্ষসী ওকে চর্বণ করেছে এবার গ্রাস করবে। দরিদ্র মহেন্দ্র কি করতে পারে ওর বিরুদ্ধে। ওর সঙ্গে লড়াই করবার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার অর্থ মাধুরী যদি জানতে পারতো ঘূর্ণাক্ষরে তাহলে হয়তো মহেন্দ্রকে সুইজারল্যাণ্ড পাঠাবার ব্যবস্থা করতো কিন্তু মাধুরীর সে দান নেওয়া সম্ভব ছিল না মহেন্দ্রের পক্ষে।
পলায়নের গূঢ়তম কারণ এই মাধুরী। এ খবর জানাবে না, জানাবে না মহেন্দ্র তাকে। নিঃশব্দে মুছে যাবে মহেন্দ্র পৃথিবীর বুক থেকে মাধুরী নিরাপদে কোন যোগ্য ভাগ্যবানের গলায় মালা দিল, তাই দূর দূরতম দেশে চলে এল মহেন্দ্র। কিন্তু এই নির্বান্ধব পূরীতে তো সম্ভব নয়। অন্তরের অব্যক্ত প্রেম বহ্নিবুকে নিয়ে মহেন্দ্র কি আবার কলকাতায় ফিরবেনা সেখানে ফিরে মাধুরীর বিপদ আর ঘটাবে না সে। সেখানে গেলে তার বিষয় মাধুরীর সব কিছু জানবার বিশেষ সম্ভাবনা আর জানতে পারলে মাধুরী চেষ্টার ত্রুটি করবে না, মহেন্দ্রকে বাঁচিয়ে তুলতে, কিন্তু মহেন্দ্র নিজে জানে বাঁচা সম্ভব না। এখানে আসার আগে কলকাতায় শ্রেষ্ঠ চিকিৎসককে সে দেখিয়েছেন গোপনে তিনি বলেছিলেন, প্রচুর অর্থ আর প্রচুর বিশ্রাম দরকার এর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। ওর কোনটাই ছিল না মহেন্দ্রের, এখানে মৃত্যুটা ত্বরান্বিত হলো ভালোই। ওর জন্যে ভাবছে না মহেন্দ্র ভাবছে তার খোকনের জন্য। কিন্তু মহেন্দ্র আজন্ম ঈশ্বর বিশ্বাসী ভাবল এই অনন্ত বিশ্ব যিনি চালান, তিনি খোকনকে দেখবেন।
কিন্তু মহেন্দ্রর নিজের দেখতে ইচ্ছে করছে একবার খোকনকে। কতদূর বাংলাদেশের সেই ক্ষুদ্র পল্লী। কিন্তু যেতে হবে খোকনকে একবার দেখতে হবে তার পর মহেন্দ্র যাবে। জীবনের পারে, যেখানে মাধুরীর জন্যে অপেক্ষা করার অন্তরায় নাই, মহেন্দ্ৰ দাদাকে চাই লিখে দিল বাড়ি যাবার দিন ঠিক করে।
অফিসের কাজে ইস্তফা দিয়ে মহেন্দ্ৰ সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরল অতি কষ্টে। জ্বর হয়েছে। ওখানকার যে ডাক্তারটি ওকে দেখেছিলেন, তিনি বলেছেন বাড়ি চলে যান ওখানে আর কেন? অর্থ আত্মীয় স্বজনের কাছে গিয়ে মরুনগে। মহেন্দ্র হাসলো কথাটা শুনে। সেও জানে সে সত্য। তিনি চলে গেলে মহেন্দ্র নিঃশব্দে শুয়ে ভাবতে লাগলো পৃথিবীতে কেন সে এসেছিল। সর্বত্র সে শুধু পরাজিত হয়েছে, শৈশবে মা বাপের স্নেহ পেল না দাদাবৌদি সে অভাব পূরন করলেন, কিন্তু দাদাও অন্ধ হলেন। অতিশয় মেধাবী ছাত্র হয়েও মহেন্দ্র পড়তে পারল না। একটা চাকরি যোগাড় করে করে দাদাকে সাহায্য করতে পারেনি সে শত চেষ্টা করেও। অবশেষে চাকরি যখন মিললো, সাফল্য যখন সম্মুখে সাহিত্য, সঙ্গীতে যখন সে নাম কিনছে তখন দূরস্ত ব্যাধি যাকে ঠেকিয়ে রাখা অসাধ্য মহেন্দ্রের পক্ষে। সর্বত্র তাই বিফলতা, আবার যেটা সে কল্পনাও করতে পারে নি, সেই প্রেম এল তার জীবনে, এমন নিবিড় হয়ে এলো যেন শ্রাবণের বর্ষণে কিন্তু হায়রে অদৃষ্ট। জীবন পাত্র যখন দ্রাক্ষারসে টলমল করছে, তখনই সে স্বর্গ সুধাকে পদদলিত করে আসতে হলো। মহেন্দ্র এ অভিশাপ তার জীবনে। সর্বশেষ অবলম্বন খোকনকেও ছেড়ে যেতে হবে, বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছে।
জল খেল মহেন্দ্র এক ঢোক, মনে পড়লো দমদমার বাগান ওষ্কার ধ্বনি করতে গিয়ে মহেন্দ্র এই ব্যথাটা অনুভব করেছিল, তখন ও জানেনি কিসের এ ব্যথা কিন্তু তার পরিণাম আজ পরিস্ফুট।
ভাবছে মহেন্দ্র মাধুরী কিছুই জানতে পারবে না তার সম্বন্ধে। অকৃজ্ঞতা এবং প্রেমের অবমাননাকারী ভেবে মহেন্দ্রকে মন থেকে মুছে দেবে, তার সুযোগ ও করে দিয়ে এসেছে। মহেন্দ্র ডাকবাক্সে বৌদির চিঠিখানা ফেলে রেখে।
আহা বৌদি, সে ভাবছে, মহেন্দ্রের, বিয়ে দিয়ে ঘরে একটা সঙ্গিনী আনবে হায়রে অদৃষ্ট। চিঠিখানা পেয়ে হয়তো চমকে উঠবে ওরা, কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে খোকন। না খোকনের এখানে অত জ্ঞান হয়নি, কিন্তু দাদা বৌদি?
একখানা উপন্যাস বেরিয়েছে মহেন্দ্রের, আরেকখানা দিয়েছে পাবলিশারকে, তৃতীয় খানাও শেষ করে যেতে পারবে হয়তো। রেকর্ডখান কয়েক ওর গানের সকলের মালিক করে দিল ওর খোকনকে এবং সবাইকে জানিয়ে দিল তার ঠিকানা যেন কাউকে জানানো না হয়। অতঃপর সেতারখানা আর বিছানা বালিশ বেধে মহেন্দ্র ট্রেনে চড়ে বসল একদিন।
পূজার বেশি দেরি নাই, মহেন্দ্র ততদিন টিকতেও পারে কিন্তু হাসি পেল ওর। ভেবে কি লাভ। তাকে যেতে হবেই আজ হোক আর দিন কয়েক পরে থোক তবে খোকনের পূজাটা ভালভাবে কাটবে মহেন্দ্র এই ক’দিন থাকলে।