দ্বিতীয় বিভাগে গোশালা। মাধুরী বললো, এতে দুধ হবে এবং আপনরার খাঁটি দুধ কিনে নিতে পারবেন, বারো বছর ছেলেমেয়েদের জন্য জনপ্রতি এক পোয়া পাবেন, দাম চার আনা, রোগীর জন্য ডাক্তার যতটা বলতে পারবেন, ঐ দামেই কিন্তু আমি কয়েকজন গুপ্তচর নিযুক্ত করেছি কেউ কোন রকম আমাকে ঠকাবার চেষ্টা করলে তবে তার বাড়িতে দুধ দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এর উদ্বোধন করবে আমার ভ্রাতুস্পুত্র শ্রীমান বাদল বলে রাখাল বেশ পরিহিত বাদলকে হাত ধরে টেনে আনলো মাধুরী। তার হাতে একটা বড় বাঁশের ডাণ্ডা হাসছে খুব। ঠেলে দরজা খুলতেই একপাল গরু ছাগল দেখা গেল
বাদল তার মাঝখানে গিয়ে একটা ছাগলের পিঠে দুই ডাণ্ডা লাগিয়ে দিল।
বাঃ বাঃ আচ্ছা গোপালোকী বলে উঠলো দর্শক দল। সবাই হাসছে মাধুরীও হেসে ওকে কোলে তুলে আবার আরম্ভ করলো–
এই বিভাগটার নাম গোষ্টি বিভাগ–এর পর ফুলের বিভাগটা দ্বারা খুলবেন আমার বান্ধবী শ্রীমতি মলিনার দেড় বছরের কন্যা কল্যাণীয়া মালতী বলে সে বাড়ির পশ্চিম দিকের সেই বৌটির কোল থেকে সাজানো মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল তৃতীয় দরজায়। ছেড়ে দিল। মেয়েটাকে। দরজাটা ফুলের মালা দিয়ে আটকানো আছে মালতী অর্থাৎ দেড় বছরের মেয়েটা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে মালাটায় কামড় লাগালো দর্শকরা হেসে খুন কিন্তু ভড়কে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। আচ্ছা লোক ঠিক করেছে মাধুরী দ্বার উদঘাটন করবার জন্য। কিন্তু সত্যি সবাই খুশি হলো–বক্তৃতা নাই বাগ্মিতা নাই মাধুরী শুধু বললো শুনুন, বক্তৃতা এখানে হলো না হবেও না। এখানে কাজ। সমস্তটার নাম বজ্রধাম—আর তিন ভাগের তিনটি নাম হিন্দোল বিভাগ, গোষ্ঠ বিভাগ আর ফুলদোল বিভাগ। দুধ কিনতে যারা একান্ত অসমর্থ হবেন ছেলে বা রোগীর জন্য এবং প্রসূতির জন্যও তারা আবেদন করলে অনুসন্ধান করে বিনামূল্যে কিছু দুধ দেবার ব্যবস্থা হবে এখান থেকে। বাড়তি দুধে খাঁটি ঘি হবে, আপনারা কিনতে পারবেন কিন্তু তাও রোগী বা প্রসূতি ছাড়া কাউকে বেচা হবে না। আপাততঃ এই আইন রইল দরকার হলে অন্য আইন করা হবে। টাকাকড়ি, চিঠিপত্র এইসব অফিসের ঠিকানায় পাঠাবেন এই সমাজ সেবায় কোন কর্মী ফাঁকি দিচ্ছে বা ঘুষ খাচ্ছে, কিম্বা কোন লোক ঠকিয়ে দুধ নিচ্ছে, ধরিয়ে দিতে পারলে নগদ একশো টাকা পুরস্কার পাবেন। আর যার দরকার ছাপানো ফর্মে আবেদন করবেন, অনুসন্ধান করে সেই মত টিকিট দেওয়া হবে এবং তদানুযায়ী সকাল আটটার মধ্যে দুধ পাবেন। ফুল ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এবং কাঠের শিল্পের বিভাগ বেলা দশটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
অতঃপর মাধুরী সকলকে গোশালা, কারখানা এবং ফুলবাগান দেখালো। তার বান্ধবী মেনকা, গীতা এসেছে, বললো তোর মহীনদা কৈ রে মাধু? আসেনি?
এটা তারই কাজ কিনা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন। না, আসেননি তিনি নিজে কি কাজ করছেন?
আমার বাঁশীটা তিনি বাজাচ্ছেন বলে চলে গেল মাধুরী অন্যত্র। গীতা আর মেনকা হাসলো। ওরা জানে, মাধুরীর মা বাবা দাদা এত নির্বোধ নয় যে ঐ ষাট টাকার কেরানীর হাতে মেয়ে ছেড়ে দেবে। গীতা বললো ওকে হয়তো তাড়িয়ে দিয়েছেন ওরা। মাধুরীকে খুব বশ করেছিল ভাই ছেলেটা।
কি জানি বেশ গাইতে পারে কিন্তু গান শুনলে ওকে সত্যি ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। ওর গান নাকি রেকর্ড হয়েছে রে মেনকা? দাদা বলেছিল, রেকর্ড খুব জনপ্রিয় হয়েছে।
হতে পারে। দোকানে খোঁজ নেব বলে মেনকা গাড়িতে চড়লো।
মাধুরী রয়ে গেল ওখানে, বিস্তর কাজ তার রয়েছে, অফিস গোছানো, খাতা পত্র ঠিক করা, গরু ছাগলের দেখা, ফিরতে রাত হয় ওর। কিন্তু সবাই চলে গেল। উমেশবাবু গেলেন মাধুরী একা একান্ত একা। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো সেই মা ছেলের মূর্তিটার কাছে দেখতে লাগলো। মূর্তিটা যেন সজীব হাসছে মাধুরীকে দেখে না না, হাসবার তো কিছু হয়নি–যার সঙ্গে মাধুরী সেদিন এসেছিল, সে আজ সাথে নেই, হাসবার তো কথা নয়, কিন্তু ওটা মূর্তি শিল্পীর খুশি মত হাসে কাঁদে সন্তানকে বুকে নিয়ে স্বগর্বে হাসছে, সার্থক নারীত্ব–ও মা! ওর পরে কিছু হবার নেই। ওর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে কেন হাসবে না।
কিন্তু মাধুরী–না, মাধুরী ওখানে দাঁড়াতে পারলো না আর দল ছাড়া একটা বাচ্চা হাঁস এদিকে এসে পড়েছিল তাকেই কোলে তুলে নিল। জলের ধারে দাঁড়ালো গিয়ে। হাস কোলে ওর প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে। হাসটাকে ছেড়ে দিল সে চলে যাচ্ছে। মাধুরী তাকিয়ে রইল তার পানে অনেকক্ষণ।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, ফিরতে হবে নিঃশব্দে উঠলো মাধুরী। পাখিরা সব কুলায় ফিরছে কয়েকটা বক উড়ে চলে গেল। শরতের প্রসন্ন আকাশে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড। মাধুরী হেঁটে আসছে বাগানের পথ দিয়ে একা কত ফুল কত সুন্দর পাতা কত প্রজাপতি উড়েছে সীমা সংখ্যা নাই শাড়ির গেরুয়া আঁচল ভর্তি করে ফুল তুলতে পারে তুলবে নাকি? তুললো কতকগুলো, রাস্তার মোড়ে যেখান থেকে মহেন্দ্র কার্ড দিয়েছিল ওকে, সেখানে এসে থামলো অনেক গুলোফুল আঁচলে আরো তুলবে? কিন্তু কি হবে? মাধুরী অকস্মাৎ আঁচলটা উজাড় করে ফুল গুলো ঐ খানেই ঢেলে দিল।
অফিস ঘরে এসে বসলো মাধুরী, লোকজন কাজ করছে। খানিক তদারক করলো গল্প ছাগলকে খাবার দেওয়ালো অতঃপর আর কি করা যায়? অফিস ঘরটা দোতলা উপরে উt গেল মাধুরী। এখানে ওর নিজের থাকার মত ব্যবস্থাও করে রেখেছে তবে আজই থাকবে না দরকার মত থাকবে। ঘরটা দেখলো একবার চোখ বুলিয়ে সুন্দর নীড় একটি। বড়দা মাধরীর যোগ্য করেই তৈরি করিয়েছে। সংলগ্ন স্নানাগার দু’পাশে বারান্দা ফুলের টব আর নীচে থেকে উঠে আশালতা দিয়ে ঘেরা একটি কুঞ্জ ঝিলের জলটা চমৎকার দেখায় দক্ষিণের বারান্দা থেকে। টাকা মানুষকে সম্পদ দান করে কত সৌভাগ্য কিন্তু সুখ শান্তি তৃপ্তি টাকা দিতে পারে। সেগুলো? না মাধুরীর সারা মন প্রাণ ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো।