মহেন্দ্র আর জবাব খুঁজে পাচ্ছে না, অসম্মান বোধ হচ্ছে ওর। অকস্মাৎ হাসির যেন ঝরণা বইছে। সুমিষ্ট হাসিটা থামাতেই চায় না। এক মিনিট পরে বললো মাধুরী–আমি এই বাড়ির কাউকে আপনি বলি না, সবাইকে তুমি বলি সবাই আমার আপনার। তোমাকে এই অপমানজনক কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমায় ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম যে, এখানে। তুমি অত্যন্ত আপনার। সবাই তোমাকে তুমি বলবে। এ বাড়ির মালিক তোমার বাবার কাছে। দেনা হয়ে আছেন। নিজেকে এত কুণ্ঠিত ভাববার কারণ নেই, এসো তোমাকে কলকাতায় প্রতিমা বিসর্জন দেখাবো বলে গাড়ির দরজা নিজের হাতে খুলে দিল মাধুরী। মহেন্দ্র জীবনে চড়েচি এত বড় মোটরে।
বুইক গাড়ি নিঃশব্দ সঙ্করণশীল। কখন যে মাধুরী আর মহেন্দ্রকে নিয়ে বাগবাজারে পাঁচ রাস্তার মোড়ে এসে পড়লো। বোঝাই গেল না, দাঁড়ালো গাড়ি। রাজপথ আলোকাকীর্ণ শোভাযাত্রা করে প্রতিমা বিসর্জন করতে চলেছে কলকাতার বারো মারা পুজকেরদল। কী চমৎকার প্রতিমা, কী তার সাজ–সজ্জা। কী অপরূপ ছন্দায়িত যেন দেখার বস্তু সত্যিই। মহেন্দ্র মুগ্ধ বিস্ময়ে এই মহোৎসব দেখছিল অকস্মাৎ মাধুরী বললো—
বিশ্বের মা শ্বশুর বাড়ি চলেছে তুমি আজ এলে, মহীনদা।
হ্যাঁ কেন? মহীন চমকে প্রশ্ন করলো।
আজ দিনটা ভালো কিনা, তাই বলছি। বিজয়াদশমী। হাসলো মাধুরী। মহেন্দ্র কিছু বললো না, মহেন্দ্রের গ্রাম্য মস্তিস্কে মাধুরীর সুক্ষ ব্যঞ্জন কোন রস সৃষ্টি করতে সমর্থ হল না।
ওর তখন খোকনের কথা মনে পড়েছে তাকে এই উৎসব সমারোহ করে দেখাতে পারবে। মহেন্দ্র কবে? এমনি বুইক গাড়িতে বসিয়ে না হোক পায়ে হেঁটে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ও কি সে তার শিশু দেবতাকে এই উৎসব দেখাতে পারবে না? অবশ্য দেখাবে।
কি ভাবছো, মহীনদা?
খোকনটাকে মনে পড়ে গেল—বাড়িতে থাকলে কাঁধে চড়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখতে যেত। কে জানে কে এবার তাকে নিয়ে যাবে?
যেই হোক নিয়ে যাবে তার জন্য ভাবনা কি? আসছে বছর খোকনকে এখানে এনে আমিই নিয়ে যাব কোলে চড়িয়ে। খোকন দেখতে কেমন?
আমাদের বংশের চেহারা সব প্রায় এক রকম রং ঢং আকৃতি।
ও বুদ্ধিটাও যেন তোমার মত না হয় বলে মৃদু হাসলো মাধুরী।
না, না ওর বুদ্ধি সত্যি খুব ভালো। যদি পড়াতে পারি—
দিগগজ হয়ে উঠবে, এই তো, বেশ, পড়ানো যাবে। তার জন্যে আজ থেকে ভাবনা কেন?
আমি অভাবের জন্য পড়তে পারলাম না, ওকে পড়াতে হবেই। আমাদের বংশে ছাড়া মুখ কেউ নেই, দাদাও কাব্য ব্যাকরণতীর্থ চোখের অসুখ হলে–
থাক্ থাক্ ওসব আমার জানা হয়ে গেছে মাধুরী বাধা দিল–তোমার বিদ্যাদিগগজ হবে হবেই। আপাতত চল বাড়ুজ্যেদের প্রতিমা দেখবে খুব প্রাচীন চণ্ডীমন্ডপ ভাঙা অবস্থা, তবু দেখতে কত সুন্দর এসো। মাধুরী দরজা খুলে নামলো, মহীনও নামলো দুজনে ঠাকুর বাড়িতে ঢুকল গিয়ে।
নবমীর দিন রওয়ানা হয়েছে মহেন্দ্র বাড়ি থেকে, খোকনই তাকে পাঠিয়েছে বলা চলে, কিন্তু কাকার যাওয়ার পর থেকে ছেলেটা আর কারও সঙ্গে কথা কয়নি রাতটা ঘুমিয়েছিল, বিজয়াদশমীর সকালেই শিউলী ফুল কুড়িয়ে রেখে খিড়কীর পুকুরটা একবার ঘুরে এলো–দু পয়সার বেলুনটা ফুঁ দিয়ে যতদুর সম্ভব ফুলিয়ে ফাটিয়ে দিল, অপরাজিতা ফুলগুলো তুলে দু’হাতে চটকে তাল পাকালো, তারপর আর কীকরা যায়?
অন্ধ বাবার কাছে বড় একটা যায় না সে না ডাকলে প্রায় যায় না! আবার পুকুরঘাটে এসে দেখতে লাগলো। পোনামাছের বাচ্চাগুলো অল্পজলে খেলা করছে এখনি ও দু’চারটে ধরতে পারে কিন্তু ধরে কি হবে? কাকু বাড়িতে নেই, ভাজা মাছের কাটা বেছে কে ওকে খাওয়াবে? থাক্ গে। একটা ঢিল ছুঁড়ে মারলো ঘাটের জলে মাছগুলো ত্বরিতে সরে গেল, ঠিক সেই সময় ডাকে–খোকন। বাবা নয়, মা ডাকছে। উঠে এলো খোকন, মা ওর পানে চেয়ে বললো—-
আয় জামাটা পরিয়ে দিই? পূজা দেখতে যাবি না?
না বলে খোকন সরে পড়তে চায়।
কাকু তো চার পাঁচদিন পরেই আসছে অত মন খারাপ করছিস কেন? তুই তো পাঠালি। যা ঠাকুর দেখে আয়।
না বলে উঠোনের এক কোণে শিউলী গাছটার কাছে দাঁড়ালো গিয়ে। ফুলগুলো সকালেই কুড়িয়ে রেখেছে, তার হলদে বোটাগুলি ছিঁড়তে লাগলো শুকিয়ে রাখবে। সরস্বতী পূজোর সময় বাসন্তিরঙ্গের কাপড় পড়বে। মা জানে খোকনের মনের অবস্থা, আর কিছু বললো না। একটু পরে ডাক দিল আয়, মুড়ি আর নারিকেল কোরা খাবি? না বলে খোকন নিজের কাজ করতে লাগলো। অন্ধ দেবেন্দ্র ও ঘর থেকে বললো ওকে কেন মিথ্যা ডাকাডাকি করছ, যা খুশি করে কাটাক। মহীন না ফেরা পর্যন্ত অমনি তো করবে। ওকে বল যে; কাকু লক্ষ্মী পূজার দিন ফিরবে।
ও জানে। খোকনের মা তাকে আর কিছুই বললো না? অভাবের সংসার। আজ বিজয়াদশমী বাড়িতে বহু ব্যক্তি প্রণাম করতে আসবে। তাদের মিষ্টি মুখ করাতে হয়। অন্য মিষ্টি কিছু জোগাড় করা যাবে না, গুড় আর নারিকেল দিয়ে নাড় তৈরি করছে। আর যৎসামান্য মিঠাই কিনে আনা যাবে। আজকের দিনে বাড়িতে তো খালি মুখে কাউকে ফেরানো যাবে না, নিজে না খেয়েও অতিথির জন্য আয়োজন করে রাখতে হয়, খৈ কিছু ভাজা আছে, তাই দিয়ে মুড়কি তৈরি করবে। অন্য বছর খোকনের কত উৎসাহ থাকে এসব ব্যাপারে। উনুনের কাছ ছাড়া হয় না বকুনী খায় তবু। এবার কিন্তু কাছ দিয়ে ও এল না। আচ্ছা কাকাভক্ত ছেলে যাহোক? মা নিজেই একটু হাসলো?