আর একচোট হাসি কিন্তু বড়বৌদি অনুভব করলো কুমারের কণ্ঠে মহীনের ভাষা। এ কি অনুকরণ?
এ সব আলোচ্য কথাবার্তা সবই মাধুরীর অসাক্ষাতে। ওকে কেউ শুধোয় না মহেন্দ্রের কথা, তার প্রসঙ্গই তোলে না, মাধুরীর সমুখে। যে মানুষটা তিনমাসে এ বাড়িতে একটি বিশেষ মানুষ থেকেছে সে সরে যাওয়ার পর তার অস্তিত্বকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এমন কি যে ঘরটায় মহেন্দ্র থাকত তাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করিয়ে মেজদার অফিস ঘর বানিয়ে দিয়েছে, চেয়ার টেবিল, টেলিফোনে আকীর্ণ সে ঘর এখন। মহেন্দ্রের ছেঁড়া পুথি। দু’খানি ফেলে দিয়েছে কোথায় কে জানে মহেন্দ্রের অস্তিত্ব এরা সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত করে দিতে চায় এখানে। কারণ নিজের ঘরে খাল কেটে কুমীর ডেকে আনে না।
কিন্তু এতটা করা যে কত বড় ভুল হলো, ওরা ভাবলো না। যার জন্য ওদের এই আপ্রাণ প্রচেষ্টা, সে কিন্তু তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করেছে এটা। সঙ্গীতের আসর, সাহিত্যের আসর সবই ঠিক আছে, শুধু মহেন্দ্রের কথাই উচ্চারিত হয় না কোথাও। এখানে বাড়িতে একটা কুকুর বিড়াল দু’দিন থেকে চলে গেলেও মানুষ বলে, আহা কুকুরটা আজ নাই, অথবা বিড়ালটা বড় জ্বালাতন করতো। মহেন্দ্র সম্বন্ধে এতটুকু কথাও শোনা যায় না এখানে। এই নীরবতা মাধুরীর অন্তরের কোন অতল তলে গিয়ে সরব হচ্ছে, ওরা কেউ খোঁজ নিল না। ওরা ইংরেজি প্রবচন ভাবলো, আউট অব সাইট, আউট অব মাইও। মহেন্দ্রকে ওরা তাই মুছে দিল ওদের সর্বাঙ্গীন স্মৃতি থেকে। এদিকে মাধুরী একা তাকে ধরে রাখবে তার মানস মন্দিরে। কিন্তু মহেন্দ্র সম্বন্ধে অন্য সকলের একটা নীরবতা ওর কেমন অসহ্য বোধ হয় অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যেতে চায় এতখানি অগ্রাহ্য করলো তারা মহেন্দ্রকে এই বেদনা ও সইতে পারে না।
মাঝে মাঝে মাধুরীর মনে হয় চীৎকার করে সকলকে জানিয়ে দেবে মহেন্দ্রকে সে ভুলবে না সে ভুলতে পারে না। মাধুরীর অন্তরে একটা লোক বাসা বেধেছে সে মহেন্দ্র জীবনে তাকে না পায় ক্ষতি হবে না, মৃত্যু অতিক্রম করে চলবে সে মহেন্দ্রর কাছে ওদের নীরবতা মাধুরীর অন্তরকে আরো সরব শক্তিময় করছে সতী করে দিচ্ছে, কিন্তু কিছু করবার নাই, কিছু বলার নাই, নিজের অন্তরকে সম্পূর্ণভাবে সংগুপ্ত করে মাধুরী দমদমার নীরবতা মাধুরীর অন্তরকে আরো সরব শক্তিময় করছে সতী করে দিচ্ছে, আহার ন্দ্রিা পর্যন্ত হয় না সময়মত অবিশ্রাম অনুধ্যান করে ঐ কাজটার তদারক কতটা করে এতগুলো কাজ।
পরিকল্পনা নেহাত মন্দ করেনি, বাগানটার নাম ব্রজধাম, ঐ নামই রইলো। ওতে তিনটি বিভাগ থাকবে ফলের খেলনা এবং কাঠের শিল্প কাজের আর গরুর দুধের। গরু এবং ছাগল তো থাকবেই, হাঁস মুরগীও থাকবে ওখানেই। তিনটি নাম মাঝে ফুল অফিস ঘর এবং পাশে গোশালা আর কর্মীদের থাকবার ঘর তৈরি হচ্ছে। বড়দা নিজে কন্ট্রাকটর এবং লোকজন মালমশলা সবই হাতে, কাজেই অতি দ্রুত কাজ হয়ে গেল। এখন উদ্ধোধন করা হবে। গাই গরু কেনা হয়েছে ষোলটা, ছাগল বিশটা, শ’খানেক হাঁসমুরগী তাদের জন্য যথাপযুক্ত লোকও রাখা হলো। ফুলের জন্য মালী তো ছিলোই, কাষ্ঠ শিল্পের জন্য আটকালো না, কারণ উমেশবাবু নিজেই বড় ব্যবসায়ী অতএব পূজার কিছু পূর্বেই সব এরকম হয়ে গেল যাতে উদ্ধোধন করা চলে।
অতঃপর উদ্বোধনের দিন ঠিক করে মাধুরী ছাপানো চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ করলো দমদমার ঐ পাড়ার সমস্ত অদিভাসীকে এবং নিতান্ত জানাশোনা তার সহপাঠিনী মেনকা, গীতা, বিপাশা ইত্যাদি কয়েকজনকে। কে উদ্ধোধন করবেন কিছুই জানল না। একটা কিছু সে করছে, এইটুকু জানিয়ে দিল নির্দিষ্ট দিনে বাগানের সামনে প্রকাণ্ড প্যাণ্ডেলটা ভর্তি হয়ে। বেশির ভাগই ওখানকার দরিদ্র মধ্যবিত্ত আর তাদের গৃহিনীগণ, বালক বালিকা এবং কুলি ম জ্বর। লাউডস্পীকার আছে, কিন্তু ডায়েসে কোন লোক নাই, ফুলের মালাও নাই এমনকি চেয়ারও নাই একখানা। এ কি রকম উদ্ধোধন, কেউ বুঝতে পারছে না, কিন্তু যথাসময়ে মাধুরী তার বাবার হাত ধরে এসে উঠলো ডায়াসে। অতি সাধারণ একখানা মিলের শাড়ি পরনে, হাতে গলায় কোন গহনা নাই, উমেশবাবুও দাঁড়ালেন। মাধুরী তার বাবার হাত ধরে। এসে উঠলো মাধুরী বক্তৃতা আরম্ভ করলো
সমবেত ভদ্রমহিলা, মহোদয়গণ এবং বালক বালিকারা।
ব্রজধাম এর দ্বার উদ্ঘাটন করতে আমি কোন লাটবেলাট রাজা মহারাজাকে ও ডাকিনি কারণ, এটা আপনাদের জন্য করেছি, তাই এখানকার সব ব্যাপারে আমি সাধারণ হতে চাই। এখানে কোন রকম ধনপূর্ব বা আভিজাত্য কোনদিন ঠাই পাবে না, এটা হবে। সহজ, সরল সত্যের ধাম স্বাস্থ্য আর আনন্দ বিতরণের জন্য এর প্রতিষ্ঠা আশীর্বাদ করুন, এই কাজ যেন সফল হয়।
এখানে আমি একটা বক্তৃতাবাগীশ আর আপনারা সব হলেন শ্রুতি তীর্থ। অতএব শুনুন প্রথমত এখানে কাষ্ঠ শিল্প এবং দেশীয় খেলনা তৈরি হবে। এর নাম দিলাম হিন্দোল বিভাগ, পায়ের খড়ম থেকে রুটি করা চাকী বেলুন এবং নানারকম খেলনা আর কাঠের পুতুল থেকে ছবি বাঁধা ফ্রেম পর্যন্ত পাবেন আপনারা এখানে ন্যায্য মূল্যে। এর উদ্ধোধন করবেন আমার বাবা। এবং এই কারখানায় তৈরি প্রথম খড়ম জোড়াটি উনি খরিদ করবেন।
হাততালি পড়লো এবং উমেশ বাবু প্রথম দরজাটি খুলে ভেতরে ঢুকলেন, মাধুরী তাঁর পায়ে খড়ম জোড়া পরিয়ে দিল।