পরদিন সকালে বড়দা মাধুরীকে নিয়ে বেরুলো দমদমার বাগান দেখতে। প্ল্যান মত কোথায় কি করা হবে তার জন্যই তাদের ফার্মের দুইজন ইঞ্জিনিয়ারও অন্য গাড়িতে গেলেন। কয়েকখানা ঘর তৈয়ার করতে হবে এবং আরো নানান কিছুর দরকার ফেরা পথে মাধুরী চুপচাপ বসে আগের গাড়িতে।
খেয়াল তোর কতদিন থাকবে ছোটদি? বড়দা প্রশ্ন করলো।
খেলাল নয় দাদা প্রয়োজন। আমার জন্যে, তোমার জন্যে এবং আরো অনেকের জন্য।
কিন্তু বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে এগুলো করা চলে বোনটি।
হয়তো যেমন তেমন ভাবে চালানো যায় কিন্তু তাতে তো একনিষ্ঠ আসে না দাদা, নিষ্ঠা ভাগ হয়ে যায় যে কোন তপস্যার পেছনে একনিষ্ঠতা থাকা দরকার।
তাহলে কি বুঝবো, তোর এটা তপস্যা। বড়দার প্রশ্নটা কেমন যেন ক্রন্দন ভরা।
তপস্যা কিছু খারাপ নয় দাদা, মাধুরী হাসলো, বাবার তপস্যায় আমাদের এত বড়লোক করেছে, মোটরে চড়ে বেড়াচ্ছি, তোমার তপস্যায়ই আমরা নির্ভয়ে খাই, দাই, ঘুমোই, আমার তপস্যায় যদি কারো কিছু ভাল হয় তো হোক গাড়িটা গেটে ঢুকলো।
হোক বড়দা যেন ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, টাকার আমাদের অভাব নাই দিদি, বাবা যথেষ্ট রোজগার করেছে, তার সিকি অংশ তোর আর আমাদের গোটা পরিবারের সব স্নেহ তোর উপর রইল, যা তুই চাইবি, যাতে তুই সুখী হবি, তাই করে দেব।
আমি জানি, বড়দা এই মূলধন নিয়ে আমি তপস্যায় বেরুলাম।
মাধুরীর গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকলো। বড়বৌদি শেষের কথাগুলো শুনল বড়দার সঙ্গে। মাধুরীকে পেছনে ফেলে প্রশ্ন করলো–
তাহলে বাগানই করবি বিয়ে করবি নে।
বিয়ের ব্যাপারটা আমার কাছে একটা পুরুষের সঙ্গে একটা মেয়ের জীবন বেঁধে দেবার চুক্তিপত্র নয় বৌদি, আমার কাছে ওর অর্থ আত্মার সঙ্গ আত্মার অখণ্ড মিলন, শোলার টোপর আর শাঁখের বাদ্যি না হলেও সেটা হতে পারে, চলে যাচ্ছে মাধুরী।
মাধুরী। জড়িয়ে ধরলো বড়বৌদী ওকে, চোখে জল আসছে, বললো, তোকে মাঝখানে রেখে তোর দাদার খাটে শুয়ে থাকতাম, কত স্নেহের ধন তুই আমাদের। এ অভিশাপ কেন তুই মেনে নিবি, বাগান করে আর গরু পুষে কি মেয়েদের জীবন কাটেরে দিদি
মাধুরী বিব্রত এবং বিপন্ন হয়ে পড়ল। তাই মাতৃসীমা স্নেহশালী বড়বৌদিকে অন্তরে , প্রগাঢ় শ্রদ্ধা করে মাধুরী আর কেউ হলে দু’কথায় উড়িয়ে চলে যেত, কিন্তু ওখানে ওকে ভাবতে হয়। কষ্টে হাসি এনে বললো–
বুড়িয়ে যাইনি বৌদি এই তো উনিশে পড়লাম, বিয়ে এরপর করতেও পারি কাউকে।
এমন দিন কি হবে রে ছোটদি।
কি জানি শাখে তো জল দিয়ে রাখ, ঠিক সময়ে যেন বাজে।
বলে আর দাঁড়ালো না সটান উপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিল আর সে অভিনয় করতে পারছে নির্দয় অভিশাপে ওকে জড়িয়ে ধরেছে নাগপাশের মত। দরজা বন্ধ করে মাধুরী হাত ফুলগাছে রাখলো, সেই না জানা ফুল, দেরাজ থেকে মহেন্দ্রের ফটোখানা বের করে ওর পাশে রেখে বললো–
শোন এর নাম রাখলাম স্বাক্ষী ফুল, তোমার আমার মিলনের স্বাক্ষী, চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে।
মহেন্দ্র যাওয়ার পর, কেন গেল, এবং কোথায় গেল, এ আলোচনা যে না হয়েছে তা নয়, কিন্তু সবই মাধুরীর অসাক্ষাতে, অনেকের ধারণা মহেন্দ্র নিজেকে একান্তভাবে মাধুরীর অযোগ্য ভেবে চলে গেছে, মেজবৌদির এই মতটা প্রবল। ছোটদা এবং বৌদির মত হচ্ছে, ওদের দু’জনার কোন রকম ঝগড়া বা মান অভিমান হয়েছে, মহেন্দ্র তাই আত্মগোপন করলো। মেজদা বলে, মাধুরী যে ভুল করতে যাচ্ছিল, মহীন এটা তাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য চলে গেছে। বড়দার কোন মত নাই, মহেন্দ্র চলে যাওয়ায় মাধুরী যাচ্ছে ভেঙে পড়ে এই তার ভয়। আর বড়বৌদির মত হচ্ছে মহেন্দ্রের যাবার পিছনে এমন কিছু আছে, যা অগ্রাহ্য করা কারো সাধ্য নয়। সে কারণটাও বড়বৌদি যেন আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে সেটা বলা চলে না সহজে, অন্ততঃ বলতে সে চায় না।
উমেশবাবু এবং গিন্নীমা মহেন্দ্রের এই ভাবে চলে যাওয়াটাই কিভাবে গ্রহণ করলেন, জানা যায় না। ইচ্ছে করলে তাঁরা দেবেন্দ্রকে পত্র লিখে খবর নিতে পারতেন, কিন্তু মেজবৌমা বাধা দিল, বললো যে পিতৃবন্ধুর পুত্র হিসাবে মহীনকে যথা সাধ্য স্নেহমমতা। দেখানো হয়েছে এবং তার প্রতি কোন অকর্তব্য হয় নাই। এরপর সে যখন অকস্মাৎ নিরুদ্দেশের পথে চলে গেছে তখন তাকে যেতেই দেওয়া উচিত সে সংসারী হবে কি সন্ন্যাসী হবে, গরীব হবে কি ধনী হবে, কিছু এদের এসে যায় না।
অতঃপর বন্ধুদের কথা আসে, মাধুরী যেভাবে মহীনকে নিয়ে মেতে ছিল। এই কমাস তাতে সোসাইটির সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, মহেন্দ্র চলে যাওয়ায় যেন চাঁদ রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছে, এমন ভাব সকলের। কুমার বললো–
রাহুরমুখ থেকে মুক্ত মুখ চাঁদ যে দাগ হয়ে উঠে বৌদি, তখন তার আলো সুন্দর হয়।
হ্যাঁ–বড়বৌদি বললো, কিন্তু রাহু না হয়ে যদি সাপের ছোবল হয় তো বিরাট ভেতরে কাজ করে সে বড় যন্ত্রণা কুমার বাহাদুর।
না, না, চাঁদ এত উঁচুতে যেখানে সাপ পৌঁছাতে পারে না হাসলো সবাই কুমারের। কথায়!
কি জানি, বড়বৌদির কণ্ঠ বিষণ্ণ বাবার কাছে শুনেছিলাম কেতুর চেহারা নাকি সাপের মতন
কিছু ভাবলেন না, ঐ গরুর গোবর ও বিষ নেমে যাবে। সবাই হাসতে লাগল কুমারের কথায়! হাসিকে আরো উস্কে দেবার জন্য কুমার বললো ঐ দমদমায় দু’মাস থাকলেই ওর দম আটকে আসবে, তখন সোসাইটিতে ফিরবার জন্যে হাসুপাকু করবে দেখবেন।