দু’মাসে কিন্তু মন্দিরটা দেখা হয়নি, চললো। ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে, নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো মহেন্দ্র দেওয়ালের সামনে, সোপানাবলী পার হয়ে তবে ভেতরে যেতে হবে, কিন্তু মহেন্দ্র অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আর উঠে উপরে যাওয়া অসম্ভব। মহেন্দ্র ঐ সোপানের এক ধারে শুয়ে পড়লো।
দীর্ঘক্ষণ শুয়ে রইল মহেন্দ্র অকস্মাৎ মনে হলো মাধুরীকে আজ ছোঁয়া হয়নি আজ তার পূজা হয়নি যেন, মাধুরী অভিমান করে বসে আছে বাড়িতে। উঠেই ফিরলো বাড়ির পানে। রাত্র অনেক, একা পথ হেঁটে বাসায় এসে অদ্ভুত মহেন্দ্র সেতার নিয়ে বসলো, স্তব্ধ কক্ষের ঘুমন্ত কন্যা যেন জাগ্রত হয়ে উঠল মুহূর্তে কিন্তু যে রাজকুমার তাকে জাগালো তার রক্তাক্ত রসনা লেলহী হয়ে উঠলো সেতারের তন্ত্রীতে।
ঘরের ক্ষীণ আলোতে দেখলো মহেন্দ্র আবার আঃ। মহেন্দ্র নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো সেতারটা কোলে নিয়েই।
.
আশ্চর্য। আমাদের একবার জানালো না পর্যন্ত। একেই বলে নিমকহারাম। বিয়ের নেমতন্ন পাবেন মেজদি বললো ছোট বৌ, মেজবৌ এর কথার উপর।
ব্যাপারটা অন্য কিছু নয়, মাধুরী যে চিঠিখানা মেস থেকে এনেছে সেটা বড়বৌদি দেখেছে এবং বাড়ির সকলে জানতে পেরেছ যে, মহেন্দ্র কোলকাতায় নেই, অকস্মাৎ চলে গেল। এখানে কোন কিছু বলে না যাবার কারণ কেউ ওরা খুঁজে পাচ্ছে না। অতঃপর ঠিক করলো যে মহেন্দ্রর বৌদি তার বিয়ের সম্বন্ধে কথা, লিখেছেন, সে খবর এখানে প্রকাশ করতে মহীন লজ্জা বোধ করেছে, শুধু লজ্জা নয় ভয়ও করেছে কারণ মাধুরীর সঙ্গে তাকে অবাধ মেশার সুযোগ এরা দিয়েছিল। মহেন্দ্র সে সুযোগের অসম্মান করেছে, অতএব না বলে পালিয়েছে। কথাটা মনের মত হোল, কিন্তু মাধুরী স্বয়ং এই আলোচনায় উপস্থিত নাই। অতএব আর কে কি ভাবলো দেখে লাভ নাই। শুধু বড়বৌ বললো সকলকে
থেমে যা ভাইসব মাধুরীর মনটা আগে জানি তারপর কথা হবে।
এর আর জানা জানি কি দিদি, মেজদা বললো মহীন কোন নোলক পড়া কনে বৌকে বিয়ে করবে, তাতে মাধুরীর কি? ওকি মাধুরীর যোগ্য নাকি? ছোঃ। থাম মেজবৌ, ধমক দিল। ভালবাসার ব্যাপারে যোগ্য অযোগ্য তোরা কে কত দেখিস, আমার জানা আছে। খেলার মাঠে মেঝঠাকুরপোকে দেখে তুই কি রকম ঘায়েল হয়েছিলি মনে আছে। তোর কানা দেখে মা তোকে এ বাড়িতে আনলেন নইলে হাসলো বড়বৌ। মেজবৌ হেসে বললো।
তুমি কি মনে কর দিদি, মাধুরী ওকে ভালবাসে?। ভাল তো বাসেই–তবে ভালবাসার নানা রূপ আছে গোপা! সেটা বোনের ভালবাসা হতে পারে। দু’চারদিনের অপেক্ষা করলেই বোঝা যাবে।
এত ভালবাসা নিয়ে তিন জায় কি পরামর্শ তোমাদের? বলে মাধুরী এসে উপস্থিত হলো অকস্মাৎ! ছোটবৌ ওর বন্ধু হতে চায় বলে বসলো।
আমাদের ছোটদি কাকে ভালবাসবে তাই নিয়ে বাজি ধরা হচ্ছে।
তাই নাকি!!
বেশ বেশ কার কি মত শুনতে পারি কি?
না, তোকে শোনালে চলবে কেন?
তুই আগে ভালবাস, তারপর আমাদের কার জিৎ হলো বোঝা যাবে বড়বৌ বললো।
যদি কাউকে না ভালবাসি তাহলে তো আমারই জিৎ হবে।
তা কি হয় রে ছোটদি, হাসলো সবাই ওরা, ভালবাসতেই হবে। বিয়েও করতে হবে। খামাকা সময় নষ্ট করছিস বললো মেজবৌ।
একেবারে সময়ই নষ্ট করে ফেললাম। আচ্ছা, তোমরা সকলেই আশ্বস্ত হও হে আমার পরম শুভাকাঙ্খিণী বৌদিগণ আমি অবিলম্বে ভালবাসব, প্রেমে পড়ব, এমনভাবে পড়ব তোমরা গলায় দড়ি দিয়াও টানিয়া তুলতে পারবে না। সবাই হাসলো ওর কথায়।
বাড়িতে কিন্তু ব্যাপারটা ঘোরালো হয়ে দাঁড়ালো গোপনে গোপনে। বৌদিদের এবং দাদাদের বদ্ধমূল ধারণা যে মাধুরী বেশি আকৃষ্ট হয়েছে মহেন্দ্রের প্রতি। ওদের চোখে মহেন্দ্রের যোগ্যতা কম, তবু ওরা স্নেহের বোনটিকে সুখী করতে মহেন্দ্রের হাতেই তাকে দিতে আরজি হতো না, সেই মহেন্দ্র অকস্মাৎ যে কোন কারণে হোক গেছে কোথাও। সংবাদটা একদিক দিয়ে খারাপ হলেও অন্যদিক দিয়ে খুব ভাল সংবাদ ওদের কাছে। মহেন্দ্র গেছে, ভালই হয়েছে, তার আর কোন সংবাদ নিয়ে দরকার নাই। তার প্রসঙ্গই বাদ দেওয়া হোক এ বাড়িতে এবং মাধুরী যাতে অপর কোন যোগ্য পাত্রকে অবিলম্বে ভালবাসতে পারে। তার ব্যবস্থা করা হোক।
অতএব সকাল থেকে রাত্রি বারোটা পর্যন্ত গান গল্প খেলা চলতে আরম্ভ করলো রতনি। এবং তার বন্ধুর দল গানের আসর জমায়, গল্পেরও। মেজদা চালায় খেলার ব্যাপারটা এবং বড়বৌ নিতান্ত নিরীহ হলেও তার ভাই বরুণকেও প্রায় আসতে দেখা যায় এ বাড়িতে। কুমার এবং তার সঙ্গিনী ডেইজী তো প্রতিদিনের অতিথি সব ব্যাপারটাই মাধুকে নিয়ে, সরে পড়বার সময় পায় না মাধুরী। অবিরাম আহ্বান আসছে, হয় সেজদা না হয় ছোটদার কাছ থেকে বড়দাও ডাকে সময় সময়, কিন্তু বড়দা অন্য কথা কয় না, বলে স্নেহের সুরে তোকে শুকনো লাগছে কেন রে দিদি।
না দাদা খুবই তো ভাল আছি? মাধুরী হেসে জবাব দেয়।
খান তিনেক যুদ্ধ জাহাজ এসেছে আমেরিকা থেকে, চল, দেখে আসবি।
মাধুরী দাদার সঙ্গে বেরুতে বাধ্য হয়, না গেলেও দাদা ভাববে মাধুরীর অন্তর অসুস্থ। জোর করে হেসে, গল্প করে, কত কি বায়না ধরে, কিন্তু স্নেহের সত্য দুরবীনটা বড় জোরালো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। বলে–
মার্কেটে চল, ফুল কিনে দিই–
ও বাসি ফুল দিয়ে কি হবে বড়দা?
বাসি ফুল ওরা কেমন সুন্দর টাটকা রাখে চেয়ে দেখো–