.
দূর বোকা মেয়ে। মাধুরী হেসে বলল রাণীরা থাকে রাজমহলে, তোদের দুঃখ কি তারা দেখতে আসে। চলে এল মাধুরী মোটরের কাছে। মুখটা মুছে নিল অনুপ সিং দেখার আগে। তারপর চড়ে বসতে বললো
বাড়ি চলো সিংজি কথাটায় এত বেশি ক্রন্দন যে নিজেই চমকে উঠলো মাধুরী।
কিন্তু অনুপ সিং অত লক্ষ্য করবে না। দীর্ঘদিনের পুরানো লোক সে। মাধুরীকে জন্ম থেকে দেখছে। স্নেহ করে নিজের কন্যার মত। নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মতলার মোড়ে ভিড় গাড়িটা থামাতে হলো।
কাগজের ঠোঙায় লজেন্স চিনাবাদাম বিক্রি করছে একটা লোক, অন্য একজন বেচছে বেলুন এগিয়ে আসছে মাধুরীর গাড়ির দিকে। মাধুরী বলল চালাও সিংজী এরা বড্ড বিরক্ত করে —
গরীব আদমী হু জ্বর বলে অনুপ সিং ধমক দিল হকারকে এই ভাগ গে।
ভাগবার লোক নয় ওরা বেলুনওয়ালা ঠিক এসে দাঁড়ালো এবং বললো বিরক্ত হলে চলবে কেন বলুন, আপনারা না কিনলে আমরা খাই কি? আমাদের তো ছেলেপেলে আছে। দেব দুটো
দিন–মাধুরী একটা আধুলী ফেলে দিল ওর হাতে–কটি ছেলেমেয়ে আপনারা?
গুণে বলতে হবে স্যার। গরীবের ঘরে ওরা অগুন্তি আসে। চারটা বেলুন ভেতরে দিয়ে সে চলে গেল। গাড়িও ছাড়ল! মাধুরী হাসছে ওর কথাটা শুনে। কিন্তু দেখতে পেল এক জোড়া বর বধু খাচ্ছে। বধুটিকে দেখলো মাধুরী দেখতেই লাগলো গলা বাড়িয়ে। মাধুরীর। গাড়ি ঐ ট্যাক্সির পাশাপাশি আসতেই খোলা গাড়িতে কনের কোলে অকস্মাৎ বেলুন চারটা ফেলে দিল? মাধুরীরে গাড়ি বেগে চলে যাচ্ছে। আপনার রসিকতায় হাসছে মাধুরী। ওদের ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্যই দিল। ভাঙ্গা বাসাটা স্রোতে ফেলে দিয়ে এসেছে, গাড়ি নীড়টাকে। কিছু তো দিল।
মুখের হাসিটা ওর মিলাচ্ছে না আর একবার গলা বাড়িয়ে দেখতে চাইলো অনেকে, মুখে হাসি কিন্তু চোখে জলটা যে রোধ করা যাচ্ছে না। হোল কি মাধুরীর? এত দুর্বল তো ও নয়। না মাধুরীর অন্তরের মৌচাককে কে যেন নিংড়ে দিচ্ছে। অসহায় মাধুরী শুয়ে পড়ল নরম কুশনের উপর।
সুদীর্ঘ পথ, মন বিষণ্ণ শরীর অবসন্ন, মাদ্রাজ শহরে এসে নামলো মহেন্দ্র। অর্ধমৃত মনে হচ্ছে ওকে। কিন্তু এই দূর বিদেশে, কোন আত্মীয় স্বজন নাই নিজেই নিজেকে দেখতে হবে।
আপনার অন্তর দিয়ে রচনা করে প্রেমস্বর্গ ও ত্যাগ করে এসেছে নিষ্ঠুর নিয়তি ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, কে জানে।
মাদ্রাজ ব্যাঞ্চের ঠিকানা ছিল সেখানে পৌঁছাতে অসুবিধা হোল না বেলা নয়টায় পৌঁছাল মহেন্দ্র। ও কি রকম দেশ? ধনীর প্রসাদের পাশে দরিদ্রের কুটির বাংলাদেশের চেয়েও প্রকট বেশি ওখানে। কিন্তু ওসব ভাবলে চলবে না। মহেন্দ্র ওখানকার অফিসে দেখা করলো।
ওখানে যিনি আছেন, তিনি মাদ্রাজী হলেও অতিশয় আদরে মহেন্দ্রকে গ্রহণ করেন। কাছাকাছি একটা কম খরচের বাড়িতে তার থাকবার জায়গাও ঠিক করে দিলেন। একতলা একটি ঘর বড় গরম কিন্তু ভাড়া খুব কম কাজেই মহেন্দ্র এখানে আস্তানা গাড়লো। নিজেই। রান্না করে খাবে, আর যদি কোনদিন না রাঁধতে পারে হোটেলে খেয়ে নিবে। কুইক সার্ভিস বলে এক রকম খাদ্য পাওয়া যায় এখানে নানারকম আনার দিয়ে তৈরি হয় চাইবা মাত্র সার্ভ করে, তাই এর নাম কুইক সার্ভিস।
মাদ্রাজ শহরটা দেখতে দু’একদিন গেল মহেন্দ্রের। বাড়িতে দাদাকে লিখে জানালো তার এখানে আসার কথা এবং কলকাতার প্রকাশক আর পত্রিকার অফিসেও জানিয়ে দিল কিন্তু মাধুরীকে বা উমেশবাবুকে কিছুই জানালো না।
এই অকৃতজ্ঞতা ওকে পীড়িত করছে কিন্তু মহেন্দ্র নিরুপায় কেন? কেউ জানে না, জানে মহেন্দ্র স্বয়ং আর বিশ্বনিয়ন্তা বলে যদি কেউ থাকেন। ভীরু মহেন্দ্র পালিয়ে সে এল, প্রেমের অপমান করে এল মহেন্দ্র। মাধুরী ভাববে এবং এ কথাই ভাববে। মহেন্দ্র ভীরু মহেন্দ্র কাপুরুষ, মহেন্দ্র অশক্ত দুর্বল শুধু নয়, মহেন্দ্র অকৃতজ্ঞ, মহেন্দ্র অ–প্রেমিক। উপায় নাই, অন্য আর কিছু উপায় নাই। মাধুরীর ভাল হোক, সে রাজরাণী হোক মহেন্দ্র সর্বান্তকরণে কামনা করে। শিবের গলার মালা সে শিবের গলায় দিতে পারে না–না, না–
চোখে জল মহেন্দ্রের কিন্তু দুর্বল হলে চলবে না। আরও কঠিন হতে হবে। এখনো। অনেক বাকি আছে তার দুঃখের এরপর আছে নিবিড় অমাবস্যার নিবন্ধ অন্ধকার–নির্মম নিয়তি। মহেন্দ্র প্রথম দিন হোটেলে খেয়ে অফিসে গেল। এখানে যত গরম তত লঙ্কার ঝাল তেঁতুলের টক। আম সস্তা কিন্তু স্বাদ নেই, বাংলার বাগানের আম মনে পড়ছে তাদের খিরকী পুকুরের গাছের আম।
ওঃ কতদূর। কত দীর্ঘ দূরত্ব। কিন্তু মন এমন বস্তু যে মহেন্দ্র এই মুহূর্তে তাকে মাধুরীর কাছে পাঠাতে পারে, মাধুরী এই কয়মাস তার অনুক্ষণের সঙ্গিনী ছিল।
অফিসে কাজ করছে। মাত্র তিন জন লোক, একটা বেয়ারা, মহেন্দ্র একটা চিঠি টাইপ করছে প্রথমেই কলে কাগজ লাগিয়ে কলকাতা অফিসের ম্যানেজারের নাম লিখতে হবে। মহেন্দ্র খট খট করে টাইপ করে ফেলল মাধুরী ভট্টচার্জ। রবার দিয়ে মুছলো সেটাকে মহেন্দ্র লিখে ফেলল মাধু ম্যানেজার শব্দটাতে ভুল হলো।
দূর হোক কাগজখানা খারাপ হয়ে গেল। মহেন্দ্র ফেলে দিয়ে অন্য কাগজ নিয়ে আবার টাইপ আরম্ভ করলো। দারুণ গরম পাখা চলছে, তবুও অস্বস্তি লাগে মহেন্দ্র কষ্টে শেষ করলো চিঠিখানা।