–কি চমৎকার। ঐ আলাপটা?
–হ্যাঁ। মহেন্দ্র জবাব দিল।
–একদম বাজে। আসুন এ দিকে।
–কেন। মহেন্দ্র যেতে যেতে বললো। বাজে কেন? মালকোশ রাগ–
–থাক। ও শুনলে আমার মাথা ধরে–ওটা খাঁটি নয়, নকল রেকর্ড গলা রেকর্ড, তার থেকে রেডিওতে, সেখান থেকে আপনার কানে। তিন নকলে আসল আর থাকে কোথায় মশাই। এই যে এই দিকে মার কাছে চলুন।
–আমার বেশ ভাল লাগলো আলাপটা মহেন্দ্র অতি আস্তে বললো।
আপনার পছন্দটা অত্যন্ত দীন বলতে বলতে ফিরে দাঁড়ালো মাধুরী। বললো, দেখুন, আপনি নিজে দরিদ্র হতে পারেন, আপনার পছন্দকে দরিদ্র করবেন না, চৌরাস্তার মোড়ের গান ওটা, রেকর্ড আর রেডিওর আমি ভালো ওস্তাদ আনিয়ে আপনাকে মালকোশ শুনিয়ে দেব আসুন।
মহেন্দ্র যেন এতটুকু হয়ে গেল, কোথায় নিয়ে যাবে, কি আবার বলবে। কে জানে। ভাল জামা–কাপড় পরায় মহেন্দ্রের কুণ্ঠা কিছুটা কমেছে এখন তবু বিদ্যার স্বল্পতা তাকে যেন আড়ষ্ট করেছিল। তারপর এই তীক্ষ্ণাধী তরুণী যার প্রতি কথায় বিদ্যুতের কণা, মহেন্দ্র। নিরুপায়ের মত চলল। খানিকটা সিঁড়ি নেমে একটা বড় ঘরে তার লাগাও একটা ছোট কুঠরী। আগাগোড়া মার্বেল বাধানো–দেওয়ালে নানা দেবদেবীর ছবি, মেঝেতে সুন্দর আসনের উপর একজন স্থলাঙ্গী বৃদ্ধা তার পাশেই একজন অবগুণ্ঠীতা বধু। বধুটি অত্যন্ত সুন্দরী বয়স ত্রিশের কম। বোধ হয় বড় বৌ। মাধুরীর পিছনে মহেন্দ্র এল।
–মাঃ এই মহীনদা বলে পরিচয়টা সংক্ষেপে সারলো মাধুরী, আর ঐ বড়বৌদি,
-–এসো বাবা, বলে হাত বাড়ালেন বৃদ্ধা। মহেন্দ্র ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রমাণ করলো তাঁকে তারপর বড়বৌদি ঘোমটা কমিয়ে দিয়ে বললো। খুব ছেলেমানুষ। আমি ভেবেছিলাম কতই বা না বড় হবে।
–ইনি বড়দা নন মাধুরী বললো বড়দা বাড়িতে আছেন তিনি দাদার থেকে বড় বুঝলে বৌদি? বড়দার নাম দেবেন্দ্রনাথ মা তুমি তো জানো।
–হ্যাঁ মা জানি। এসো মহীন বলে বৃদ্ধা তাকে কাছেই বসালেন, তারপর বধুকে আদেশ করলেন জল খাবার আনতে।
মহীন এই ছোট সুন্দর ঘরখানি আর তার দেওয়ালের ফটো দেখবে কিংবা সম্মুখের মাতৃস্বরূপিণী ঐ মহিলাকে দেখবে বুঝতে পারছে না।
–এতদুঃখ পেলে বাবা, মহীন, আমাদের একটা খবরত দিতে হয়। –ভুল হয়েছিল কাকিমা, কষ্টভোগ মহেন্দ্র বললো।
–না মা, গরীবের অভিজত্যেবোধ–মাধুরী বললো ব্যঙ্গ করে যেন। বড় বৌ খাবার নিয়ে এল।
বসে খাওয়ালেন মহেন্দ্রকে বৃদ্ধা ছেলের মত যত্ন করে। ওর মধ্যেই সংসারের খবর জেনে নিলেন। মাধুরী কোথায় গেছে কে জানে। মহেন্দ্র অনেক স্বস্তিবোধ করছিল ওর অনুপস্থিতিতে, যেন জলন্ত অগ্নিকুণ্ডটা কাছে নাই। তার স্নিগ্ধ উত্তাপটুকু রয়েছে।
তোমার বাবাকে আমি দেখেছি মহীন, তুমি তেমন হয়েছ। চেহারায় এত মিল।
বাবাকে আমার ভালো মনে পড়ে না–মহেন্দ্র বললো।
হ্যাঁ তুমি তখন খুবই ছোঠ। তিনি যে উপকার আমাদের করেছেন বাবা। মুঙ্গেরে ওর টাইফয়েড হলো, তোমার বাবা দিন রাত্রি জেগে ওকে বাঁচালেন। সেই সময় তাকে দেখেছিলাম রুগী যায় যায় হলো, তোমার বাবা বললেন, কেঁদো না বৌমা–যমের সাধ্য নাই যে তোমার সিঁথির সিঁদুর মুছবে। আমার পরমায়ু দিয়ে আমি ওকে বাঁচাব–ঝরঝর করে জল গড়ালো বৃদ্ধার চোখে।
তাই তো তোমার কূল উজ্জ্বল করা সন্তানেরা পায়ে জুতো নাই, আর কাপড় ময়লা দেখে নাক সিটকে পালাল–আর ঐ কুমার না কুমাণ্ডা। মাধুরী অকস্মাৎ অভিভুত হয়ে বললো কথাগুলো! কণ্ঠের দৃঢ়ম্বর ভাষার ঝলকে যে অগ্নিবৃষ্টি ঝরছে বড়দার অন্তত এটা উচিত হয়নি মা। কি বলবি? আমি বলবো বড়দাকে।
বলবো যে, এই অকৃতজ্ঞতা উমেশ ভট্টাচার্জির বড় ছেলের উচিত হয়নি আর মেজদা ঐ কুমারটাকে এনে খারাপ অবস্থা করেছিল, ভাগ্যিস আমি সে সময় গিয়ে পড়েছিলাম। যাকগে মেজদাকে কিছু বলবো না, বড়লোকের জামাই, বিলেতে যাবে, তার কথা বাদ দাও। দেখি ছোট দা এসে কি বলে।
নারে, কেউ কিছু বলবে না ওরা ঠিকমত বুঝতে পারে নি, মহীন কত আপনার। ওর আবার বুঝবার কি আছে মা। ক্ষেত্র জ্যাঠার ছেলে এই–ই যথেষ্ট পরিচয় ওর। আবার কি বুঝবে হাতী ঘোড়া। এতকাল খবর নাও নি তার জন্যে অনুতাপ কর।
কেউ কিছু বললো না। একটু পরে মাধুরীই বলল বড় বৌদি–দক্ষিণ দিকের কোণের ঘরটায় মহীনদার থাকবার ব্যবস্থা করলেন বড়বৌদি, তুমি একবার দেখিয়ে দিয়ে। সব ঠিক আছে কিনা, আমি ওকে নিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখতে যাচ্ছি। মহীনদা গাড়ি তৈরি?
কোথায় যেতে হবে? মহীন ভয়ে ভয়ে তাকালো।
অত খবরে কাজ কি। যা বলছি চটপট এগোন। মহীন উঠে, চললো ওর পিছনে নামতে নামতে বললো–আমার গামছার পুটলীটা–
যা, আছে তো একখানা ছেঁড়া লুঙ্গি আর খানকতক হিজিবিজি কেতাব কি ওগুলো?
পঁথি সেকেলের হাতে লেখা পুঁথি।
কি হবে ও দিয়ে। পড়াই তো যায় না।
পন্ডিতরা পড়বেন। বিক্রি করার জন্যে এনেছি।
আচ্ছা আমিই কিনে নিবো, দুটোর দাম চার টাকা হয়ে রইলো।
আপনি ও দিয়ে কি করবেন? মহেন্দ্র অকস্মাৎ নির্বোধের মত প্রশ্ন করল।
আমি এই বাড়ির সবার থেকে ছোট, আমাকে আপনি বললে পর হয়ে যাবে, তুমি বলতে হয় বুঝলেন?
তাহলে আমাকেও আপনি বললে তো পর হয়ে যেতে পারি। মহেন্দ্র সাহস করে বলে ফেলল, এবার কিন্তু জবাব এল।
হ্যাঁ আপনি তো পরই, দায়ে পড়ে আত্মীয়তা করতে এসেছেন, ঠেলায় পড়ে অভাবে পড়ে, পর না হলে এমন কেউ করে নাকি?