তিনজন উঠে গেলেন। শেষের লোকটার হয়তো কিছু কথা ছিল, তখনো রইলেন। বাইরে টেনিস লনে যারা খেলা করছিল, তারা অকস্মাৎ হৈ চৈ করে বারান্দায় উঠে এলো মহেন্দ্র দেখলো তাদের। দুটি মেয়ে, চারজন পুরুষ। ওরা এবার বারান্দায় বেতের চেয়াগুলোতে বসে চা খাবে, তার আয়োজন চলছে। আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি পড়ছে তাই ওরা বারান্দায় এলো।
যে ভদ্রলোকটি এতক্ষণ বসেছিলেন তিনি এবার ধীরে ধীরে বললেন লাখ খানেক টাকাতেই হয়ে যেতে পারে ওটা। আপনি নিজে বার দেখুন, প্রকাণ্ড বাগান বাড়ি প্রায়। দেড়শ বিঘে জমি তবে একটু দূরে নইলে ওর দাম তিন লাখের কম হতো না।
–আচ্ছা আমি ভেবে দেখবো, আজ আপনি যান, আজ আর সময় হবে না, বলে উমেশবাবু মহেন্দ্রের দিকে চেয়ে বললেন,–হাত মুখ ধোও বাবা, চা খাবে। ওরে কে আছিস, এদিকে আয়।
একটা চাকর এসে দাঁড়ালো। এই চাকরটাই কিছুক্ষণ আগে মহেন্দ্রকে দরজায় দেখে গিয়েছিল? উমেশবাবু বললেন–একে পাশের বাথরুমটা দেখিয়ে দে আর তোয়ালে সাবান এনে দে।
চাকরটা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহেন্দ্রের দিকে চেয়ে চলে গেল। সে চাহনি এমনি অবজ্ঞাসূচক যে মহেন্দ্রের মনে হলো এখনি উঠে যাবে এখান থেকে। কিন্তু বাড়ির মালিকের সেই কোমল দৃষ্টি ওর সর্বাঙ্গে আপতিত রয়েছে। মহেন্দ্র স্থির হলো। ঠিক সেই সময় ঢুকল এক যুবক।
–এই যে অতীন, বৃদ্ধ বললেন–এই আমার বন্ধু ক্ষেত্রের ছোট ছেলে। এই মাত্র এলো দেশ থেকে।
মহেন্দ্র উঠে প্রণাম করতে যাবে, কিন্তু অতীন্দ্র নামধারী যুবকটির দৃষ্টি তার দিকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্র বুঝতে পারলো উনি প্রণামটা পছন্দ করবেন না। সে হাত তুললো কিন্তু অতীন তার পানে এক নিমেষ দৃষ্টিপাত করেই বললো, ও আচ্ছা–বাণ কোম্পানীর কাজটা তাহলে ধরছি বাবা। এক লক্ষ বিশ হাজার টাকায় রফা হলো বলেই বগলের ফাঁইলটা বৃদ্ধের সামনে ফেলে এক মিনিট কি একটা কাগজ দেখলো, তারপর সটান গিয়ে ঢুকলো হল ঘরের পাশের একটি ঘরে যার খোলা দরজার ফাঁকে মহেন্দ্র দেখতে পাচ্ছিল এক বব করা মেমসাহেব খটখট টাইপ করে চলেছে। ওটা হয়তো অফিস ঘর। মহেন্দ্র ভাবতে লাগলো। এই নিদারুণ ধনলোভী মানুষগুলোর কাছে সে কেন এসেছে, কি সে এখানে পাবে। আপনার দীন বেশ তাকে ক্রমাগত কুণ্ঠিত করতে করতে প্রায় চেয়ারের সাথে মিলিয়ে এনছে কিন্তু উমেশবাবুর স্নেহদৃষ্টি তেমনি উজ্জ্বল তার সর্বাঙ্গ যেন প্লাবিত করে বয়ে যাচ্ছে।
–যতীন, বৃদ্ধ ডাকলেন জোরে। বারান্দায় চা পানরত একজন সুন্দর বলিষ্ঠকায় যুবক উঠে আসতে বললো–
ডাকছেন বাবা।
হ্যাঁ শোন, এই আমার বন্ধুর ছেলে চন্ডীপুর থেকে এসেছে, এইমাত্র এল। ও হ্যাঁ, যতীন তাকিয়ে দেখলো মহেন্দ্রকে একবার, তারপর আস্তে বললো, বেশ তো, বসুক। কুমার নৃপেন্দ্রনারায়ণ এসেছেন বাবা, আমি তাকে চা টা খাইয়ে নিই। তারপর ওর সঙ্গে আলাপ করবো। নাম কি তোমার? শেষের প্রশ্নটা মহেন্দ্রকে।
–মহেন্দ্র অতি ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল মহেন্দ্র।
আচ্ছা বস বলেই যতীন চলে গেল ব্যস্ত ভাবে।
তোয়ালে আর সাবান আনতে গেছে যে চাকরটা সে এখনও ফিরলো না, হয়তো ভুলেই গেছে মহেন্দ্রের কথা। বড় লোকের বাড়ির চাকর, কে আর মহেন্দ্রের মত অতিথিকে পছন্দ করে।
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজলো ঢং করে। ঠিক সেই সময় সুন্দর টেডি পরিহিত জনৈক যুবক আর তার সঙ্গে দুটি মেয়ে এসে ঢুকলো বারান্দা থেকে ঘরে। যুবক বললো–
শরীর ভালো আছে তো জ্যাঠামশায়? তখন লোক ছিল তাই দেখা করতে পারি নি।
–হ্যাঁ ভালো আছি। রাজবাহাদুর দার্জিলিং থেকে ফিরছেন নাকি?
–না–বাবা নভেম্বরে ফিরবেন আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
–বেশ, চা–টা খেলে বাবা? খেলা হলো তোমাদের?
–আজ্ঞে হ্যাঁ এবার যাব। বলে কুমার একচোখে মহেন্দ্রকে দেখলো।
বৃদ্ধ বললেন, ও আমার বন্ধুর ছেলে কাজকর্মের সন্ধানে এসেছে!
ও, তাই নাকি? পড়াশুনা করেছে কিছু? কুমার প্রশ্ন করলো, যেন কাজ সে দিতে পারে এক্ষুনি। বৃদ্ধ তাকালেন মহেন্দ্রের পানে। মহেন্দ্র দুর্বল কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললো–
পড়াশুনা বিশেষ কিছু করতে পারিনি, ম্যাট্রিক পাশ করার পরই দাদার অসুখ তারপর দুঃখে দৈন্যে এই কটা বছর কাটছে।
ম্যাট্রিক! বলে কুমার যেন আতকে উঠলো, ওতে কি চাকুরী জুটবে?
আচ্ছা দেখা যাবে, বলে তিনি যেমন কিছুটা বিদ্রূপ মাখা মৃদু হেসে চলে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় বৃদ্ধের পিছনের ঘরটায় মৃদু গুঞ্জন ধ্বনিত হয়ে উঠল মধুর কণ্ঠে।
কে যেন সন্ধ্যাদ্বীপ জ্বালছে।
এ ঘরের সবকটি প্রাণী নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেছে, কুমার বাহাদুরও দাঁড়িয়ে গেল, বৃদ্ধের যেন যৌবন ফিরে এসেছে অকস্মাৎ সোজা হয়ে ডাকলেন–মাধু মা। যাই বাবা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল এক অষ্টাদশী তরুণী, ডান হাতে ধুপদানী, বাঁ হাতে প্রদীপ। গৈরিক বর্ণের তনুদেহ দিয়ে জ্যোতিরেখা যেন উদ্ভাসিত হচ্ছে। দীর্ঘায়িত চোখে অবর্ণনীয় এক কোমলাভ। বৃদ্ধ বললেন, তোর বাবাকে টাইফয়েডের সময় বাঁচিয়ে ছিল যে ক্ষেত্র, তারই ছেলে। দীপ হাতে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটি, আধ মিনিট দেখলো মহেন্দ্রকে, তারপর বলল পায়ে জুতো নেই কেন?
কিনবার পয়সা নেই। মহেন্দ্র মাথা নীচু করে জবাব দিল।
–জামাকাপড় অত নোংরা।
–ওই একই কারণে।