মহেন্দ্র কোথায়? মহেন্দ্র ঠাকুরপো বলে গেছে, সে গেছে কোন অফিসের চাকুরি খুঁজতে।
ও। বলে মাধুরী আধমিনিট চেয়ে রইল। মেজবৌদির পানে তারপর বললে তোমার জানানোটা বাইরের ঢাকঢোল মেজবৌদি, মন্দিরের ভেতরের মৃদু ঘন্টাধ্বনি নয়, হলে তুমি মহেন্দ্র বলতে না মহীন বলতে। মা যা বলে বড় বৌদি যা বলে আদুরে নাম অধরকে স্নেহরসে সিক্ত করে, যার মধুর সৌরভ লুকানো যায় না, যাকগে। মহীনদা চাকরি পেলেই চলে যাবে তোমাদের আতঙ্কের কোনো কারণ নেই, তোমার কুমার বন্ধুরাই নাচবে এখানে।
চলে গেল মাধুরী। মেজবৌ নিমেশে চেয়ে রইল ওর দিকে অনেকক্ষণ। মহেন্দ্র সম্বন্ধে। অতি অল্পতেই মাধুরী যেন কেমন উত্তেজিত হয়ে যায় কেন?
কি এমন ঐ অজ পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত ছেলের? রূপে এমন কিছু রাজপুত্র নয় যদিও দেখতে ভালই। বিদ্যা তো একেবারে মাধুরীর থেকেও কম গলাটা ভাল গাইতে পারে। কিন্তু তাইবা কি এমন শিখেছে? স্বাস্থ্য তো নাই–ই। কিন্তু ও আশ্রিত। মাধুরীর স্নেহসজল নারী মন মায়ের মত ওকে ঘিরে আছে সত্যি। তো মাধুরী নায়িকা শ্রেণীর মেয়ে নয়। ওর মাতৃরূপটাই সব সময় জল জল করে। বাড়ির দারোয়ান পর্যন্ত এ সংবাদ জানে। মেজবৌ নিজের কাজে মন দিল।
উর্বশী কাগজের অফিসে গিয়ে মহেন্দ্ৰ শুনলো তার গল্পটা ছাপা হয়েছে অর্ধেকখানা বাকিটুকু এই সপ্তাহে বেরুবে আশাতীত আনন্দের সঙ্গে। আশাতীত সৌভাগ্য মহেন্দ্রের। সম্পাদক ওকে দক্ষিণা বাবৎ পনরটি টাকা দিয়ে বললেন কিছু মনে করবেন না, দুসংখ্যার জন্যই দক্ষিনা আর বেশি পারা যায় না, বাংলাদেশের পত্রিকা চালানো যে কঠিন ব্যাপার
মহেন্দ্রের কিছুই বলবার ছিল না, টাকা পাবার আশায় সে করেনি। অত্যাধিক আনন্দটা কোনো রকমে অন্তরে চাপা দিয়ে মহেন্দ্র ধন্যবাদ জানালো এবং আর বেশি বিলম্ব না করে ঐ সংখ্যার দুখানা কাগজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সটান পোষ্ট অফিসের দিকে।
এ টাকা ওর নিজের রোজগারের টাকা এই ওর জীবনে প্রথম উপার্জন। স্বােপার্জিত এবং সুদুপায়ে অর্জিত এই অর্থ সে দাদার হাতে দেবে এর একটি পয়সাও মহেন্দ্র নিজে খরচ করবে না।
মহেন্দ্র জানে উমেশবাবুর দয়ার দান দাদা কত কষ্টে গ্রহণ করেন। তিনি বাধ্য হচ্ছেন মনঃপীড়া ভোগ করছেন। কিন্তু মহেন্দ্রের অর্জিত এই অর্থ তো যতই সামান্য হোক তাকে অসীম আনন্দ দেবে।
পোষ্ট অফিসে গিয়ে একখানা কমল চেয়ে মহেন্দ্র চৌদ্দ টাকার মনিঅর্ডার লিখলো বাকি টাকার কয়েক আনা মনিঅর্ডার কমিশন। এই অর্থে সে আর কারো দানের ছোঁয়া লাগাতে চায় না কিন্তু এতটা শূচিব্যয়ুগ্রস্ত মহেন্দ্র না হলেও পারতো। হলো কিন্তু মহেন্দ্র!
টাকাটা পরশু গিয়ে পৌঁছাবে শনিবার দিন। দাদার অন্ধ নয়ন অশ্রুভরা হয়ে উঠবে। টাকাটা পেয়ে। ভাবতে গিয়ে মহেন্দ্রের নিজের চোখ দুটো জল ভরা হয়ে উঠলো। একজন বয়স্ক ভদ্রলাক ওর মুখ পানে চেয়ে বলে উঠলেন কি হলো মশাই কাঁদছেন।
আজ্ঞে না, কিছু না বলেই সলজ্জে চোখ মুছে মহেন্দ্র রাস্তায় নামলো। নিজের মনে বলল মানুষের জীবনে, মর্মান্তিক দুঃখ যেমন আছে মর্মান্তিক সুখও তার চেয়ে কম নেই।
কিন্তু মহেন্দ্র ঘরে ফিরলো না শেষ টাকাটার বাকি কয়গণ্ডা পয়সা ওর পকেটে তাই দিয়ে ও কিছু কিনবে খোকনের জন্য লাটিম না হয় বল না বশি। মহেন্দ্র ফুটপাতের দোকানগুলোয় চোখ বুলিয়ে ফিরতে লাগলো।
আর একটা গল্প লিখতে হবে অনুরোধ করেছে সম্পাদক। কি লিখবে। ভাবতে মহেন্দ্র। ঐ রকম ঘুরতে ঘুরতে বেশ বড় একটা প্লট যদি মাথায় এসে যায় তো না না না। বড় প্লট বড় লোকের জন্য। দুনিয়ায় অধিকাংশ লোকেই গরীব মহেন্দ্র তাদের জন্য ছোট গল্প লিখবে। তার মতন এমনি কত দুর্ভাগ্য পীড়িত বাবা কাকা সোনার শিশুর জন্য দু’পয়সার তালপাতা ভেপু খুঁজে ফিরছে দিনাস্তের মুখের একটু ফোঁটা হাসি দেখবার আশায় হয়তো সেই হতভাগ্য পিতা কোন ধনীর মূল্যবান মোটরের তলায়–
আহ হা। চার পাঁচজন লোক ছুটে এল অন্যমনষ্ক মহেন্দ্র কলার খোসায় পা পিছলে ফুটপাতে পড়ে গেছে। দামী কোটখানায় কাদা লেগে গেল। একজন ধরে তুলে বলল খুব লেগেছে মশাই?
না তেমন কিছু না ধন্যবাদ উঠে দাঁড়ালো। লেগেছে বেশই কিন্তু তার জন্য মহেন্দ্রের তিলমাত্র আফসোস নেই। ওর তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল অন্তর আচ্ছন্ন করে খোকনের মধুর হাসি ভেসে উঠলো। হাত ধরা বরাবরের বলটাও ছাড়েনি, পড়ে গেলেও হয়তো ছাড়বে না। মহেন্দ্র উঠেই চলে গেল।
আঃ এই পরম তৃপ্তির কথা সে পাঠককে জানাবে। তার অতি ক্ষুদ্র জীবনের অতি তুচ্ছ অনুভূতির অপরূপ সুষমা সে কি সঞ্চারিত করতে পারবে না পাঠকের অন্তরে? দরিদ্র কেরানী। পিতা মাসের শেষে মাইনে পেয়ে দু’পয়সার লজেন্স কিনে নিয়ে তার ছোট খুকুটার জন্য সে কি জীবন নয়, তাতে কি মাধুর্য নেই তার কি অমৃতস্বাদ অনুভব করবার মত অন্তর সৃষ্টি করে নেবে মহেন্দ্র শিল্পীর দরদ দিয়ে?
মহেন্দ্র স্টান শ্যামবাজারে ফিরে ঘরে ঢুকলো লিখবে কিন্তু লেখার এটা সময় নয় শীতের বিকাল এক্ষুনি হয়তো ডাক পড়বে চা খেতে কিংবা বেড়াতে যেতে। থাক রাত্রে লেখা যাবে।
মহেন্দ্র মেজদা ওর ঘরে ঢুকে ডাক দিল। এরকম খুব কমই হয়।
আজ্ঞে। মহেন্দ্র জবাব দিয়ে তাকালো ওর পানে। মেজদা বলল–