মহেন্দ্রের অসহায়তার দিকে মাধুরীর সতর্ক দৃষ্টি অগাধ অপার্থিব করুণ আকর্ষণ করে। দুর্বারভাবে এ যেন তার মাতৃমূর্তি কিন্তু মহেন্দ্রের সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতিতে মাধুরীর শাসন যেন রাজদণ্ড। সেখানে মাধুরী ক্ষমাহীন হয়তো হৃদয়হীনও। এই বিচিত্র অতলস্পর্শ শহরে পরে মহেন্দ্র নিজেকে যেন সামলাতে পারছে না।
কিন্তু চাকরীও একটা জুটছে না আর চাকরী জোগাড় করে নেবার জন্যেও কারুর মাথাব্যাথা দেখা যাচ্ছে না বাড়িতে। মহেন্দ্র আছে থাক বাড়ির একটা লোক যে সে? বাইরের কেউ এখন আর ধরতেই পারবে না যে মহেন্দ্র এ বাড়ির কেহ নয়। কিন্তু মহেন্দ্র নিজে সেই সত্যটা অনুক্ষণ অনুভব করে আত্মপরীক্ষা করে আত্ম–বিশ্লেষণ করে আপনাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করে বলে তুমি এ বাড়ির কেউ নও মহেন্দ্র তুমি নিতান্ত গরীবের ছেলে তোমার পিত্র প্রতীম দাদা অন্ধ তোমার একমাত্র ভ্রাতুস্পুত্র নাবালক তাকে মানুষ করতে হবে। পরের দানে নয় নিজের রোজগারের টাকায়।
কুমার নৃপেন্দ্রনারায়ণ আরো দু’একদিন এসেছে মহেন্দ্রের সঙ্গে দেখাও হয়েছে–
প্রশ্ন করেছে সে মহেন্দ্রকে কি করবে বা কি করতে চায় সে সম্বন্ধে। কুমার বেশি আসে না কারণ মেজদাই সস্ত্রীকে ওখানে যায়, টেনিস খেলতে বা ক্লাবে বেড়াতে কিন্তু আজ নাকি কুমার বাহাদুর এখানে আসবে তার আয়োজন চলছে।
এ পাড়াটা কলকাতায় বনেদী বাসিন্দাদের পাড়া। টেনিস খেলা বালীগঞ্জী ব্যাপার এখানে টেনিসকোড বসিয়েছে। বাড়ির কারো ওতে সম্মতি নেই, কিন্তু কিছু বললে গাছে ভ্রাতৃবিরোধ ঘটে, তাই সবাই চুপ করে আছে। মাধুরী বলে।
শ্যামবাজার শ্যামসুন্দরে ক্রীড়া ভূমি–এখানে গোচারণ হয় টেনিসে কেন? গরুচরবার জায়গা নষ্ট করে দিলে তুমি মেজদা।
কি করি বল–তোর মেজ বৌদির ঘুম হয় না–মেজদা বলে।
হবে কেন? ও তো আর গোপী নন গোপী গরবিনী রাধা ভাগ্যি কোথায় ওর? ও হোল সেই, মাধুরী থেমে যায়।
কি? কিরে ছোটদি–তাহলে কি? প্রশ্ন করে মেজো বৌ হাসে।
তুমি? মেজবৌদি গোপীনও। গোবরচনা নও। তুমি একেবারে গোবর—
ভালই তো, তোদের বাড়ি পবিত্র হোল ঘর নিকুষি।
হ্যাঁ–সে আর হতে দিলে কই। খুঁটো হয়ে উনুন জলছো যে! বলেই চলে যায় মাধুরী।
কিন্তু এসব তর্ক বিতর্ক, বাকবিতণ্ডায় ওদের অন্তরের স্নেহরস, কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। মাধুরী সকলের স্নেহপাত্রী, দাদারা ওর দোষ দেখে না বৌদিরাও দেখে না। ওকে ভালবেসেই যেন আনন্দ। ওর কথায় যেন সুরের ঝঙ্কার পায় ওরা, মেজবৌদি স্বামীকে বলল–
কথায় ওকে যে হারাবে, তার সঙ্গে ওর বিয়ে দেব।
এমন ছেলে আছে নাকি? আমি তো দেখিনি মেজদা বলে।
তাহলে বুদ্ধিতে যে হারাবে।
তেমনই বা কৈ?
কেন কুমার বাহাদুর।
তুমি ভুল করছো গোপী! কুমারের বুদ্ধিটা বৈষয়িক বুদ্ধি মাধুরী তার কাছ দিয়ে যায় না। ওর আদর্শবাদী মন কোথায় বাঁধা পড়বে কে জানে?
কুমার কিন্তু খুব আশা করে ওর সম্বন্ধে।
আমরা এক ফোঁটা করি না আর ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই আমরা করবো না।
বিয়ে দেবে না?
ওর ইচ্ছে হয় তো করবে আমরা এতগুলো ভাই ঐ এক ফোঁটা একটা বোন যা ইচ্ছে ওর করবে ও আমাদের বাড়িতে আনন্দ প্রতীমা।
বৌরা জানে দাদাদের এই মত। মা বাপের মত যাই হোক। দাদারা মাধুরীকে কোনদিন। কিছু বলবে না। না হলে মহেন্দ্রের মত কোথাকার এক অশিক্ষিত ছেলেকে নিয়ে মাধুরী এ তো মাতামাতি করছে কারও কি চোখে পড়ে না। আশ্চর্য।
কিন্তু এসব কথা বলতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়, মেজবৌ সেই দিন বাড়ির সকলের চক্ষুশূল হয়ে উঠবে। মাধুরীর মনে আঘাত দেবে বাবা বা তার দাদার কল্পনাতীত। দরকার নাই, পাঠা সে লেজ দিয়েই কাটুক, অতএব বৈকালিক অর্ভ্যথনার আয়োজন করতে লাগলো মেজবৌরাণী।
কুমার সাহেব আসবেন এবং আরেকজন কে বিশেষ ব্যক্তি আসবেন তার সঙ্গে অতএব আয়োজনও বিশেষ হওয়া দরকার। চায়ের টেবিলগুলো সাজাচ্ছে মেজবৌ, হঠাৎ মাধুরী অভিভুত হয়ে বললো–
বাঃ। মন্দ নয়। বড়দা বড়বৌদি হবে কাগিন্নী ঘর সামলাচ্ছে তোমরা হলে খেলোয়াড় খেলোয়াড়নী, বাহির সামলাচ্ছ এরপর ছোটবৌদি যদি লক্ষ্ণৌ ঠুংরী হয়ে এসে সংগীতের আসরটা সামলান তো এ বাড়ি আর দেখতে হবে মানবতোক, দানবপোক, দেহলোক সব হয়ে যাবে…।
তুই সাহিত্যের আসরটা সামলাবি তাহলে আরো কিছু হবে মেজবৌ রসিকতা করল। আর কি হবে। আর কিছু হবার নেই ঐ তিন লোকই সব–তিন লোকের তিন উপসর্গ অপবিদ্যা–অপবিদ্যাটা কে?
তুমি মেয়ে হয়ে খোলোয়াড় হচ্ছে এরপর গোঁফ গজাবে।
দুর মুখপুড়ি। মেজবৌ হেসে উঠলো–কিন্তু তুইও তো ভাল খেলতে পারিস ছোটদি। তোর গোঁফ গজাবে তাহলে।
না–আমি শুধু শিখে রেখেছি তোমার মতন বাতিকগ্রস্থ নই আমি যে এক দিন খেলা না হলে ঘুম হবে না। যাক আজ কোন মহাপুরুষ আসছেন? সে কুমাণ্ড তো? কুমাও কি করে? কুমার বাহাদুর আর মাদ্রাজের আদিলিংগমঃ ভারত বিখ্যাত যাক। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত হোন, কিছু যায় আসে না, বর্তমান যুগটা উড়োখ্যাতির যুগ।
তার মানে? উড়োখ্যাতি কি?
মানে খ্যাতিটা আকাশে উড়ছে যে পার ধরে না, খেয়ালে খ্যাতি, খাওয়ায় খ্যাতি, স্নানে, সঁতারে খ্যাতি, সৌন্দর্য খ্যাতি তাই সবাই এক এক দিক খ্যাতিমান। শুধু বীরত্বে, মনুষ্যত্বে করে কতটা খ্যাতি তাই জানা গেল না যাক আমারও গানের আসর আছে আজ! পিয়ানোটা একটু বাজিও বুঝলে, তোমাদের খেলা চুকলে আমার আসর।