কে? অর্পণা। দেবেন্দ্র সামান্য সাড়া আন্দাজ করেই বুঝতে পারেন।
হ্যাঁ, কি হলো? কাঁদছো।
না। চোখ মুছছেন দেবেন্দ্র ও কিছু না? একটু থেমে আবার বললেন, এই পরিবারের উপর একটা অভিশাপ রয়েছে অর্পণা।
ও মা কেন? কার অভিশাপ।
সঙ্গীতের ইষ্টদেবীর। এই বংশের রাগসিদ্ধ হয়ে এতো অহংকারী হয়েছিলেন সে এক দরিদ্র সঙ্গীত শিল্পীকে সামান্য ভুলের অপমান করে তাড়িয়ে দেন। চোখের জলে তিনি অভিশাপ দিয়ে যান, ওই সিদ্ধ যন্ত্র কলঙ্কিত হবে। তারপর থেকে এই বংশের অকালমৃত্যু আকস্মিক মৃত্যু অন্ধতা কিছু না কিছু লেগে আছে।
না ছিঃ ওসব রূপকথার গল্প অভিশাপ কেন থাকবে। ওসব কেন যে তুমি ভাবো।
নানা জায়গায় দরখাস্ত করেছে মহেন্দ্র কিন্তু কই কোন জবাব তো এলো না। অবশ্য আসবার সময় পার হয়ে যায় নি। ইতিমধ্যেই টাইপ করাটা আরো ভাল করে রপ্ত করে নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে অফিসের অন্যান্য কাজও করছে।
চাকরিতে ঢুকবার আগেই দাদাকে সে টাকা পাঠাতে পারছে, এটা ওর পক্ষে খুবই আনন্দের ব্যাপার হতো, কিন্তু দাদাকে সে চেনে। ওই টাকা কয়টা দান যে গভীর দুঃখের সঙ্গে হাত পেতে নিতে বাধ্য হন, মহেন্দ্রের তা অজানা নয় উপায় কি? ছেলেটা না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিল আর এই আশ্বিন কার্তিক মাসে রাজার ভান্ডারও খালি হয়ে যায়, নতুন ধান না উঠা পর্যন্ত ঘরে হাঁড়ি চড়ার কোনো উপায় নাই যদি বাজার থেকে চাল না কেনা হয়। শহরে অবশ্য সর্বত্র রেশন, কিন্তু পল্লীতে চাল কিনতে গেলে মহেন্দ্র অনেক ভেবে উমেশবাবুর এই দান গ্রহণ করেছিল।
প্রায় মাসখানেক ওর কাটলো এ বাড়িতে। কলকাতায় অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। মহেন্দ্র। রেষ্টুরেন্টে বসে কাঁটা চামচেতে খাওয়া, সেলুনে গিয়ে চুল ছাটাই করে আসে আর চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠা শিখতে দেরী লাগলো কারণ মন প্রাণ দিয়ে এসব ও পছন্দ করে না।
ঘোড়া দৌড় ক্রিকেট খেলা এবং এ জাতীয় ব্যাপারগুলো দুর্বোধ মহেন্দ্রের কাছে। কিন্তু সে দেখতে পায় এ বাড়িতে সবাই খেলাধুলা নিয়ে খুবই মাতামাতি করে। এমন কি খবরের কাগজের খেলার রিপোর্ট নিয়েও ওদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। রেডিও খুলে সবাই বসে থাকে, কোথায় কি খেলা হচ্ছে তার খবর শোনার জন্য।
যুদ্ধ কবে শেষ হয়েছে, এখানে দেশের লোকের হাতে টাকা কিছু রয়েছে–যাকে বলে ইনফ্লমেশন–কিন্তু সে আর কদিন? কিন্তু এতো কথা লোকে ভাবছে না। জিনিষ পত্রের দাম অনেক চড়া কিন্তু বিক্রি কম হয় না, কারণ হাতে পয়সা রয়েছে। মানুষ হন্যে হয়ে খেলার মাঠে টিকেট কেনে, সিনেমায় যায়, মদ খায় এবং আরো কত কি করে টাকার গরম এমনিই। মহেন্দ্র এসব দেখে শুধু লিখে রাখে তার দিনলিপিতে। এই আর্থিক উদ্বায়ী বৃত্তি, এই আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ের ব্যধি এই আত্মকেন্দ্রিকতার ভয়াবহ পরিণাম মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। কিন্তু ওর এসব ভেবে লাভ কি? তবু মহেন্দ্র ভাবে। ওর চিরন্তনশীল মন না ভেবে পারে না। গভীর রাত্রে ওর ভাবনাগুলি লিখে রাখে দিনলিপির পাতায় অত্যন্ত গোপনে সে লিখে এই দিনলিপি, মাধুরীও জানে না এই লেখার কথা। ও আজ লিখছে। কিছুতেই সে ধনী পরিবারের সাথে নিজেকে মেলাইতে পারছে না। ও যেন বাতাসে উড়ে আসা একটা ঘুড়ি, এই বাড়ির ছাদের কার্নিশে তার সুতোটা আটকে গেছে, তাই ও এখানে উড়ছে কিন্তু জানে ঐ ক্ষীণ সূত্রটুকু ছিঁড়ে যাবে আর মহেন্দ্র গিয়ে পড়বে কোন সুদূর আকাশে। সেখান থেকে হয়তো এ বাড়ির চিলে কোঠাটা নজরে পড়বে না কিন্তু সত্যি কি তাই, এ বাড়ির সব স্মৃতিই কি সে ভুলতে পারবে? না দীর্ঘ দিনের দেখা আবছা স্বপ্নের মত মনে থেকে যাবে একথা–এ স্মৃতি এর মায়া। কিন্তু মহেন্দ্র এই মায়ার শৃঙ্খল অবিলম্বে কাটাতে চায়। কেন? জানে না মহেন্দ্র ওর চিত্তে যেন অহরহ তাগিদ দিচ্ছে সারা, সরে যাও মহেন্দ্র এতখানা অসামঞ্জস্যের মধ্যে থাকলে মানুষ্যত্বের মহিমা খর্ব হয়, ক্ষুণ্ণ হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিন্তু এবাড়িতে মহেন্দ্র কয়েকটা বিশেষ সুবিধে পেয়েছে যা অন্যত্র দুর্লভ। পড়বার জন্য প্রচুর পুস্তক আর গানবাজনা শিখবার জন্য বহু রকমের যন্ত্র এবং অখন্ড অবসর ঘন্টা দুই তিন টাইপ শেখা, আর অফিসের কাজ শেখা ছাড়া তার আর কর্ম নেই। বিকালে মাধুরীর সঙ্গে। বেড়াতে যাওয়া, কিন্তু তাও হয় কোনো সঙ্গীতের আসরে না হয় সাহিত্য আসরে অথবা শিল্পকলা কেন্দ্র বা ঐরকম কিছু একটা দেখতে। অকারণে মাধুরী তাকে কোথায় নিয়ে যায়।
সেদিন ঘরোয়া সাহিত্য আসরে যে কয়েকজন সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তাদেরই একজন আজ লেখা চাইলেন মহেন্দ্রর কাছে। মাধুরী সেখানে ছিল না, থাকলে। মহেন্দ্র লজ্জায় মরে যেত কারণ সেদিন সেই আলোচনার পর মাধুরীর সঙ্গে আর কোন কথা। হয়নি এ সম্বন্ধে মতটা মাধুরী কিভাবে নিল আজো জানে না মহেন্দ্র। এই ভদ্রলোক তার। সাপ্তাহিক কাগজের জন্য লেখা চাইলেন অতিশয় সঙ্কোচের সঙ্গে মহেন্দ্র একটা ছোট গল্প এগিয়ে দিল, বলল কে জানে চলবে কিনা। আপনার যদি ভাল না লাগে তো ছাপাবেন না, খারাপ জিনিস আমি ছাপতে চাই না। আচ্ছা আচ্ছা, সে ভার আমার। আপনার লেখা খারাপ হবে আমি বিশ্বাস করি না। না না, আমি নিতান্তই অব্যাপারী, থাক, সেদিন আপনার বানীতেই বুঝেছি কি আপনি, আর কেমন আপনি। আমার কাগজটা সাপ্তাহিক সিনেমার কাগজ কিন্তু তাতেও আমি চাই আপনার মত স্বাস্থ্যকর চিন্তাধারা পরিবেশন করতে। আপনি। আগে পড়ে দেখবেন বলে সলজ্জে মহেন্দ্র নমস্কার জানালো। মাধুরী ব্যাপার কিছু জানলে না, মহেন্দ্র জানাল না তাকে। সে জানে মাধুরী ওসব পছন্দ করবে কিনা। হয়তো চোখ। পাকিয়ে বলবে–রবীন্দ্র, বঙ্কিম, শরতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সাহস কম নয় বলবে লোকের কাছে মুখ দেখানো দায় হল কি সব ছাই পাশ লিখতে শুরু করলে মাধুরী ভাল বলবে এ রকম আশা করে মহেন্দ্র হয় খারাপ বলে, না হয় কিছুই বলে না। একেই তো মহেন্দ্র নিতান্ত কুণ্ঠিত হয়ে থাকে এখন। তার ওপর প্রতি কাজে খুৎ ধরলে ও টেকে কি করে? অবশ্য আর কেউ কিছু ওকে বলে না–না ভাল না মন্দ? এমন কি অফিস ঘরে ওর যতক্ষণ ইচ্ছে থাকে, যখন খুশী চলে আসে কোন কৈফিয়ৎ নাই।