এমন দরকার ছিল–ছিল বৌদি, দরখাস্ত লিখলাম চাকরীর জন্য।
চাকরী–বলে বৌদি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, খানিক পর বললো তা বেশ তো।
৩. মাসখানেক অতীত হয়ে গেছে
মাসখানেক অতীত হয়ে গেছে, মহেন্দ্র আবার পঞ্চাশ টাকা পাঠিয়েছে কিন্তু এ টাকাও তার রোজগারের টানা না, উমেশবাবুর দান। দেবেন্দ্র নিঃশব্দে সই করে নিয়েছেন টাকাগুলো নিরুপায় হয়ে। কিন্তু দারিদ্রের অসম্মান আহত হয়েছে বার বার। শ্বশুরের ভ্রাতৃপ্রতীম কোন বন্ধু অসময়ে কিঞ্চিৎ অর্থ সাহায্য করেছে, এতে তার মনঃপীড়া হবার কিছু সে খুঁজে পায়না, কিন্তু স্বামীকে সে চেনে দেবেন্দ্র যে এই সাহায্য নিতে চাইছেন না, এটা ভালোই জানা আছে আপনার। তবু নিয়তির কাছে মানুষ এতোই নিরুপায় যে এই সাহায্য হাত পেতে নিতে হচ্ছে, এবং মহেন্দ্রকে চিঠি লিখে জানানো যাচ্ছে না এরকম সাহায্য যেন সে না দেয়, কারণ সে চিঠি উমেশবাবুর হাতে পড়তে পারে। তথাপি দেবেন্দ্র ঠিক করলেন মহেন্দ্রকে তিনি লিখে জানাবেন, চাকুরী যদি সে না পায় তো অবিলম্বে বাড়ি ফিরে আসুক। কিন্তু নিজে লেখা সম্ভব নয়, দয়ালকে দিয়ে, লিখতে হবে। খোকনকে ডেকে বললেন, তোর দয়াল দাদাকে ডেকে আনতো খোকন বেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই জন পাঁচ ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন বাড়িতে। গ্রামেরই লোক, দেবেন্দ্র স্বাগত আহ্বান জানালেন। এখন আর চিঠি লেখানো হবে না। তাই দয়ালকে ডাকতে নিষেধ করলেন দেবেন্দ্র। খোক বেঁচে গেল। কাকু চার পাঁচদিন পরে আসবে বলে আজও এলোনা। মর্মান্তিক দুঃখ ভুলতে পাচ্ছিল না ছেলেটা। বাবার কাছে থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকে, শুধু গান শিখবার সময় বাবার কাছে যায়, মুখে মুখে গান ভালই শিখেছে সে।
ভদ্রলোক কয়েকজন এসে প্রস্তাব করলেন এই গ্রামে তারা একটা চতুম্পাঠি খুলতে চান। আপাততঃ গ্রামের লোকই চাদা দিয়ে সেটা তারা চালাবে এবং সরকার থেকে বৃত্তি পাবার চেষ্টা করবে। আর চতুম্পাঠি চালাতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি দেবেন্দ্র। পাঁচটি ছাত্র পাওয়া গেছে গ্রামের পাঁচজনের বাড়িতে তারা খাবে এবং দেবেন্দ্রর ভিটার পশ্চিমদিকে যে বড় কুঠুরীটা আছে, ওই খানে থাকবে আর পড়বে। এই ঘরটাতেই এই বংশের মৃদঙ্গ সেতার তানপুরা ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে।
প্রস্তাবটা সুন্দর, উদার এই মানুষটির হৃদয় উচ্চ, এতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু দেবেন্দ্রর মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই বাড়িতেই টোল ছিল, ছাত্ররা এই বাড়িতেই অন্ন এবং বিদ্যালাভ করতো, আজ সেটা চালাবে গ্রামের লোক উপরন্তু চাদা করে মাইনেও দেয়া হবে দেবেন্দ্রকে। তাঁর দৃষ্টি হীন চক্ষু থেকে জল বেরুতে চাইছে, কিন্তু সামলে নিলেন, বললেন প্রস্তাবটা খুবই ভাল নরেশ এতো বড় গ্রামের যোগ্য প্রস্তাব কিন্তু কিন্তু কি বলুন? নরেশ শুধাল না।
আমার কি আর অত খাটবার সমর্থ হবে ভাই?
সে কি। আপনি এমন কিছু বুড়ো হয়ে যাননি।
না, না, পারবো কি করে চোখ যার নেই, পড়ানো কি তার পক্ষে সম্ভব?
হ্যাঁ সে কথা আমরা ভেবেছি, কিন্তু আপনাকে সাহয্য করতে মাধুবী থাকবে ও তো ব্যাকরণতীর্থ। আর সন্ধ্যেবেলা ঐ ঘরে সঙ্গীত চর্চা হবে, উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত, আমরা আজই ওই তবলা মৃদঙ্গ সেতারগুলো সারিয়ে আনছি, আপনি আপত্তি করবেন না দেবু দা আমরা অনেক আশা নিয়ে এসেছি।
আপত্তি করবার মত মনের জোর খুছে পাচ্ছে না দেবেন্দ্র। আজ যদি খবর পেতেন মহীন ত্রিশ টাকার কোন কাজে ঢুকেছে, মাসে দশটা টাকা দিতে পারবে তাহলে তিনি গ্রামের চাঁদায় নিজের পেট চালাবার কাজে সম্মতি দিতেন না। কিন্তু এখন ওসব ভেবে লাভ নেই, মহীনকে তিনি বাড়ি ফিরতে চিঠি লিখে দেবেন। বড় লোকের বাড়ির রাজভোগ খেয়ে ছেলেটি বয়ে যাচ্ছে হয়তো।
নরেশের দল পাশের ঘরে গিয়ে সেতার তানপুরাগুলো তুলে নিল তারপর হৈ হৈ করে চলে গেল বাজারে। ওদের উৎসাহ বিপুল, উদ্যম অসাধারণ। কিন্তু দেবেন্দ্রর মন ক্ষুণ্ণ হয়েই রইল তার পিতৃপুরুষের পবিত্র বস্তুগুলিতে অপরের সংস্পর্শ তিনি ঘটাতে চাননি তাই কিন্তু ঘটলো। ঘটুক বিধাতার ইচ্ছা। তিনি যেন আত্মসমর্পণ করলেন ভাগ্যের কাছে, ভাবলেন মানুষের শক্তি কত ক্ষুদ্র কত অসহায়তার অধীন। কিন্তু খোকনের আনন্দ ধরছে না। বাড়িতে গানের আসর হবে, নিত্য গান বাজনা চলবে কত কি আলাপ হবে, রাগ রাগিনী শিখতে পারবে। আঃ কাকু যদি বাড়ি থাকতো। কিন্তু ওই সঙ্গে একটা টোলও নাকি হবে। সেটা কি বস্তু, খোকনের জানা নেই। সেখানে নাকি ছাত্ররা পড়তে আসবে, খুব বড় বই পড়ানো হবে নিশ্চয়। ভাবতে ভাবতে খোকন ভেতরে এলো। ওর মা রান্নাঘরে, কিন্তু সেও শুনেছে। বাইরের আলোচনার কথা খোকনকে বললো।
এবার গান শিখবার খুব সুবিধা পাবি, বুঝলি।
হ্যাঁ মা, কিন্তু ওই যে টোল নাকি খুলেছে, ওটা কি?
ওটা পাঠশালা, তোকে ওখানে পড়তে হবে না।
ওটা কি জন্য হবে তাহলে?
সরকারী বৃত্তি পেলে কিছু হবে বাবা।
খোকন অতকিছু বুঝল না নিঃশব্দে চলে গেল পুকুর পাড়ের দিকে। কাকু যে কেন এতো দেরী করছে কে জানে? ওর বটের বেদীটা ভেঙ্গে গেছে, আবার তৈরি করতে আরম্ভ করলো আর একটু বড় করে।
অর্পণা রান্নাঘরেই ছিল স্বামীর কাছে কি একটা দরকারে আসছে কিন্তু দরজার কাছে এসেই দেখলো দেবেন্দ্র দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নিঃশব্দে বসে দৃষ্টিহীন চোখ থেকে জলধারা গড়াচ্ছে। অর্পণা বিস্মিত হয়ে থেমে গেল। কি হোল কেন উনি কাঁদছেন।