সুন্দর! হাততালি দিল কয়েকজন। বসে পড়ল মহেন্দ্র, কিন্তু মাধুরীর তীক্ষ্ণ চক্ষু কুমারের এই প্রস্তাব, মাধুরীর বুঝতে মুহূর্ত সময় লাগেনি, কিন্তু ঐ ছোট লোকটা জব্দ হয়ে গেল! শান্ত সুন্দর হাসি ফুটলো মাধুরীর মুখে, অতঃপর সভাপতির অভিভাষণের পর জলযোগার ভুরি পরিমাণ আয়োজন। মহেন্দ্র সঙ্গে আলাপ করলেন তারা এবং বললেন, মহেন্দ্রর সংক্ষিপ্ত ভাষণ সুন্দর হয়েছে। মাধুরী তাকালো কুমারের দিকে কিন্তু কুমার তখন কাটলেটখানা কাটতে ব্যস্ত! পাশে বসা ডেইজীকে অনুচ্চস্বরে কি যেন বলছে। ডেইজী ওর বান্ধবী। টেনিস খেলার সঙ্গিনী এবং ওদের পাড়াতেই বাস করে বছর চব্বিশ বয়স এখনও বিয়ে হয়নি। সাহিত্যিকরা আহারাদি করে চলে গেলেন মহেন্দ্র মাধুরী ওদের এগিয়ে দিল।
তারপর মহেন্দ্র গেল নিজের ঘরে, মাধুরী গেল মার পূজার ঘরে? ওখানে টেনিস খেলোয়াড়দের আলোচনা সভায় ওরা আর ফিরে এলো না। কুমারদের দল আশা করেছিলো ওদের ফেরাবার কিন্তু কৈ, অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। অতএব ওরাও উঠলো।
কুমারের অন্তরটা কেমন যেন বিষাদিত হয়ে উঠেছে। ঐ নগন্য একটা যুবক, বিদ্যাহীন, স্বাস্থ্য, সামাজিকতাহীন একটা তুচ্ছ ব্যক্তি কুমার নৃপেন্দ্রনারায়ণ কি তার কাছে হেরে যাবে? কিন্তু হারালো কোথায় নিজেকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করতে করতে কুমার গিয়ে গাড়িতে উঠলো, পাশে ডেইজী, গাড়ি চলে যাচ্ছে।
ডেইজী বলল, ছোঁকরাটা কে? ঐ শেষে বক্তৃতা দিল?
ওদের বাড়ির একটা পরগাছা। চাকরির জন্য বসে আছে?
ছেলেটা বেশ বলতে পারে তো।
হ্যাঁ এবার কংগ্রেস নির্বাচনে ওকে কাজে লাগাব—
আপনি দাঁড়াচ্ছেন নাকি?
দাঁড়াব, ওকে প্রোপাগাণ্ডার জন্য নিযুক্ত করতে হবে।
ভালো হবে, ওর বুদ্ধি আর বলবার ক্ষমতা দুটোই আছে।
তৃতীয়টা নেই, বলে মোড় ফেরালেন গাড়িটাকে কুমার।
সেটা কি?
বল। শারীরিক শক্তি, বলে আপনাদের সবার সুপুষ্ট হাত দিয়ে ষ্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন কুমার সাহেব, গাড়িটাকে অনাবশ্যক জোরে চাপিয়ে দিলেন।
সাহিত্য বাসর শেষ হওয়ার পর মহেন্দ্র নিজের ঘরে এসে বসল, ভাবতে লাগলো সে তো বেশ বলতে পারে। অল্পক্ষণের জন্য হলেও কথাগুলো সে খুব মন্দ বলেনি? নিজেকে এতোখানি অসহায় ভাববার কোনো কারণ নেই, তার ভেতর এমন একটা শক্তি রয়েছে যে তাকে সকল সাহায্য করছে। নিজের এই শক্তিটা সম্বন্ধে সে কোন দিন সচেতন ছিল না, এ যেন তার কাছে একটা আবিষ্কার। কিন্তু উৎফুল্ল হতে পারলো না মহেন্দ্র। তার বক্তৃতা মাধুরী ওকে আক্রমণ করবে, অথবা একান্তভাবে এগিয়ে যাবে ও বিশেষ কোন কথাই তুলবে না। মাধুরীর মনের গঠনটা এতটা অদ্ভুত কেন হোল, বুঝতে পারে না মহেন্দ্র। এ বাড়িতে আরো তো অনেক আছেন, কিন্তু মাধুরী এদের মধ্যে থেকেও যেন স্বতন্ত্র, ওর সঙ্গে এদের কারো মেলে না।
মাধুরীর মনে মহেন্দ্রর বক্তৃতা কি কাজ করেছে, ভেবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয় মহেন্দ্রের। পক্ষে। তার সঙ্গে দেখা হলে তখন বোঝা যাবে, তাই মহেন্দ্র কাব্য পাঠ আরম্ভ করে দিল। এখানে আসার পর থেকে ওর পড়াশোনার সুবিধা হয়েছে প্রচুর, সঙ্গীত চর্চার ও সুযোগ মিলেছে, কিন্তু ওর যেটা সারা মনপ্রাণ দিয়ে চাইছে, সেই চাকরি এখনো পায়নি। টাইপ রাইটিংটা শিখছে মহেন্দ্র, তার সঙ্গে বুক কিপিংও। হয়তো চাকরি তার একটা শিঘ্রী হয়ে যাবে, কিন্তু এ বাড়ির কেউই তার চাকরির জন্য বেশি মাথা ঘামায় না, শুধু মাধুরীই বলে মাঝে মাঝে চটপট কাজ শিখে ফেল চাকরি করতে হবে তোমার–
মহেন্দ্র রবীন্দ্রকাব্য পড়ে প্রতিটি পংক্তির ব্যঞ্জনা রসাপুত করে বিস্মিত বিমুগ্ধ করে তোলে, গড় গড় করে তাই সে পড়ে না ধীরে ধীরে রস আস্বাদন করে পড়ে, এটা ওর বরাবরের স্বভাব, কিন্তু অত ধীরে পড়ায় অপর কাউকে শোনানো যায় না তাই মাধুরী বলে–
আবৃত্তি তোমার দ্বারা হবে না মহিনদা
না হোক, আবৃত্তির জন্য কাব্য হয়নি, বলে মহেন্দ্র পড়ে চলে।
কি জন্য তবে লেখা হয়েছে? প্রশ্ন করে মাধুরী।
রসপিপাসুর অন্তরকে পরিতৃপ্তি করতে, কাব্য সকলের জন্য নয় মাধুরীর, বিমুগ্ধ জনই কাব্য সম্ভোগ করতে পারে, দেবীর করুণা, কাব্য ব্যতীত অনুভব হয় না।
যথা? মাধুরী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধোয়। যথা, অন্তর হচ্ছে আহরি বচন, আনন্দ লোক কবি বিচরণ কবির এই যে কথাটায় একটি আনন্দলোক রচিত হয়েছে, পৃথিবীর কটা মানুষ সেখানে পৌঁছাতে পারে বল তো?
আমি তো কোন লোকই খুঁজে পাচ্ছি না, না আনন্দ, না নিরানন্দ, তবে ভাষার তুবড়িবাজী দেখা যাচ্ছে, মাধুরী তর্ক করতে চায় মহেন্দ্রকে রাগিয়ে। ঐ জন্যেই তা। অরসিকেষু রহস্য নিবেদন, করতে মানা বলে মহেন্দ্র পাশ কেটে একেবারে চুপ মেরে যায়, কিন্তু মাধুরী তখনো গুঞ্জন করতে থাকে আপন মনে।
অরসিকের মধ্যে রস না আনতে পারলে কবিতা হোলো না, হোলো কচুপোড়া বেগুন ভোজন করার লোক, আর বেলফুল উপভোগ করার মধ্যে তফাৎ আছে মাধুরী।
অর্থাৎ আমি বেগুন বিলাসী আর তুমি বেলফুল বিলাসী, দুটোরই কিন্তু জন্ম এক জায়গায়, মাটিতে, অতএব এখানে আমরা আত্মীয়, কেমন?
হ্যাঁ, যেন অন্নের সঙ্গে সম্পর্ক কদলী পত্রের, সৌন্দয্যের চপট ভরে না, তার উপর ভাতের কাড়ি দরকার। বেলফুলে পেট ভরে না বেগুনও চাই, চাই–ই।