আচ্ছা বাপু যা। বেলুড়ই যা রামকৃষ্ণ, মিশনে যোগ দিলেই তো পারিস, বলে রতীন বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। যেতে যেতে আবার বলে গেল, মনে করেছিলাম ক্লাবে টেলাবে নিয়ে একটু দ্র করে দেব, পাঁচজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব তা তো তুমি হতে দেবে না। থাক অমনি জংলী ভূত হয়ে।
শহরে মামদো থেকে জংলী ভূতেরা অনেক ভালো। জবাব দিল মাধুরী।
ওরা পিঠোপিঠি ভাই–বোন, ঝগড়া প্রায়ই লেগে আছে ওদের। কিন্তু সে ঝগড়ায়। স্নেহের অভাব নাই। ছোটদা খুবই ভালোবাসে মাধুরীকে। যেখানে যায় নতুন কিছু ওর জন্য কিনে আনে। সেই লক্ষ্ণৌ থেকে একটা পুতুল কিনে আনলো।
: ও নিয়ে খেলবার বয়স পার হলাম ছোটদা, তোমার খুকীর জন্য রেখে দাও।
: তুই এখনো যথেষ্ট খুকী আছিস, নে, নে বলছি, ছোটদা ওর ঘরে দিয়ে গেল ওটা। খুশি হলো মাধুরী খুবই। কিন্তু মুখে কথা বলতে ছাড়লো না বললো, আমাকে ওরা খুকী বানিয়ে রাখবার চক্রান্ত করেছে, ছোটা সেই চক্রান্ত সভার প্রেসিডেন্ট।
: আমি না, বড়দা বললো ছোড়দা।
: আজ্ঞে তোমার ইচ্ছাই নয় যে আমি বড় হই। শাড়ি তো তুমি কিনে দিতে চাইতে। এখনো তুমি স্বীকার করছো না আমি বড় হয়েছি।
: হোসনি বলে ছোড়দা চলে গেল। ভাই বোনের এই ঝগড়া বেশ লাগে অন্য সকলের ওরা সবার ছোট, সকলের স্নেহভাজন, তাই সবাই উপভোগ করে কথা কাটাকাটি। কিন্তু মহেন্দ্র ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখলো। মাধুরীর মত বয়সের মেয়ে তার চোখে ছোট তো। নয়ই বরং যথেষ্ট বড়। ওর বিয়ে এখনো হয়নি মহীনের কাছে প্রথম প্রথম এটা অত্যন্ত বিসদৃশ লেগেছিল। এই কয়দিনে অবশ্য সয়ে গেছে এবং সে বুঝেছে সে আধুনিক যুগে এটাই চলছে কিন্তু রতীন যেভাবে মাধুরীর সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে যতখানি সহজে তার বেশি ধরে টান দিয়ে চড়টা–চাপড়টা লাগিয়ে দেয় মহেন্দ্রর পক্ষে তা সম্ভব নয় কিন্তু কেন? রতীন ওর সহোদর আর মহেন্দ্র নিতান্ত অনাত্মীয় না হলেও বন্ধুপুত্র। মাধুরীর পক্ষে সহজ ভ্রাতা–ভগ্নী ভাব কেন মহেন্দ্র আনতে পারছে না। নিজেকে কঠোর প্রশ্ন করেছে মহেন্দ্র দু’তিনদিন থেকে এটা অপরাধ হচ্ছে তার অন্তরাত্মার কাছে। নিজেকে এভাবে নীচু করা মহেন্দ্রের। মাধুরীর তরফটা সে ভেবে দেখলো, সে ঠিক সহোদরার মতো ব্যবহার করে, সহজ সরল সুন্দর। মাধুরী উঠে বললো। চলো, তোমার সেই গল্পটা শুনতে হবে।
: কিসের গল্প রে মা? উমেশবাবু শুধালেন।
খুব ভালো গল্প বাবা, ধানগাছ আর ক্ষেত্রে কাঁকর ধরার গল্প, পানকৌড়ির ডুব সাঁতার, কাঠ ঠোকরার কঠকঠ তার সঙ্গে দোয়েল, পাপিয়া, বৌ কথা কও পাখীর গল্প, ও এতো সুন্দর করে বলে বাবা, যে শুনলে তুমিও শুনতে চাইবে।
: ও, যা, শোনগে।
মহেন্দ্রকে নিয়ে মাধুরী চলে গেল। বড় বউ হেসে বললো, পাড়াগাঁ সম্বন্ধে মাধুরীর একটা স্বপ্ন আছে বাবা, ও কখনো দেখেনি কিনা।
হ্যাঁ, মা কলকাতার বাইরে ও যদি গেছে তো, দার্জিলিং কিংবা দিল্লী। পাড়াগাঁ দেখেনি।
: আমি একবার ওঁকে বলেছিলাম, আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে কুন্তী নদী বয়ে যায়। তা শুনে বললো সে নদী আমি দেখবোই বৌ, কুন্তী, মহাবারতের কুন্তী দেখতেই হবে। বললাম, সেইটা একটা খাল বিশেষ। শুনে ওর চোখ ছলছল করে উঠলো, বললো, কুন্তীর মত গরবিনী মাকে তুমি খাল বলছো? ছি। সেই থেকে আমি খুব সাবধানে ওর সঙ্গে কথা বলি বাবা।
মা বাবা দু’জনেই হাসলেন। মা বললেন ওকে নিয়ে ভারী মুশকিল রে মা। কোথায়। গিয়ে পড়বে, শ্বশুর বাড়ি কেমন হবে, বড় ভাবনা হয় আমার।
: তোমার ছেলেরা তো বলেন ওর বিয়েই দেব না। তুমি ভাবছো কেন মা ওঁরা বলে, মাধুকে নিয়ে আমরা চার ভাই, মাধু আমাদের বাড়িতেই থাকবে বিয়ে ওর দেব না।
তা কি হয় মা? মেয়ে হয়ে জন্মেছে, বিয়ে তো দিতেই হবে। তবে যতটা সম্ভব দেখে শুনে দিতে হবে, তারপর অদৃষ্ট। আর কেউ কিছু বললো না কেমন যেন গুরু গম্ভীর হয়ে উঠলো আসরটা। তারপর উমেশবাবু বললেন, অতীন কি বেরিয়ে গেছে বৌমা?
: হ্যাঁ বাবা, কিসের যেন কন্ট্রাক্ট নিয়েছেন, ভোরেই বেরিয়েছেন। মেজ ঠাকুরপো যাবেন। বোম্বাই ওদের খেলা আছে।
: মেজবৌমা যাবেন নাকি, গিন্নি প্রশ্ন করলেন। হ্যাঁ যাবার যোগাড়ই তো করতে দেখলাম, এয়ারে যাবে শুনেছি।
: এয়ারে। বড্ড আমার ভয় করে মা, এয়ারে কেন? ট্রেনে গেলেই পারতো।
: ভয় করে আর লাভ নাই মা, সবাই এ যুগে এয়ারে চলে, বাকী রইলাম আমি তুমি আর বাবা, বলে হাসলো বড়বৌ। বাবা চলুন আমরা একবার এয়ারে ঘুরে আসি, আমার ভারী ইচ্ছে হয় বাবা।
: তুই যা অতীনের সঙ্গে। আমাদের আর এ বয়সে এয়ারে পোয় না মা, বলেন। উমেশবাবু। তারপরই বললেন, মাধু শুনলেই বায়না নেবে আর আমাকে উড়িয়ে ছাড়বে। ওকে কিছু বলিস না, বুঝলি?
: ওকেই বলতে হবে বাবা তাহলে আপনারা যাবেন আপনাকে একবার এয়ারে নিয়ে যাবার বড় সাধ, হাসলো বড়বৌ।
: কেন মা হেসে শুধালেন উমেশবাবু। আমাকে উড়াবি কেন?
: বাবা, আপনি আমাদের জন্যে এতসব করেছেন, সারাজীবন খেটেছেন অথচ যুগের যে সুখ সুবিধে, তা কিছু আপনি ভোগ করছেন না। সেই ভাতে ভাত খাবেন ফরাসে বসে, গুড়গুটি টানবেন, আর সেই হাত কাটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে শীত কাটাবেন আর আমরা সব নবাবী করে বেড়াবো, এ আমার ভালো লাগে না বাবা। বড়বৌ মাথায় হাত দিয়ে বুলাতে বুলাতে বললো।