আহারের পর একটু বিশ্রাম করার অভ্যাস, দেবেন্দ্র চৌকিতে শুয়ে চোখ বুজছেন, খোকন বাইরে রোয়াকে বসে সা রে গা মা সাধছে। হঠাৎ পিওন তাকে কি যেন বলল, খোকন তিন লাফে ভিতরে এসে বললঃ
বাবা, ও বাবা টেলিগ্রাম নাকি, কাঁপছেন দেবেন্দ্র উদ্বেগে।
আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু, টেলিগ্রাম মানি অর্ডার, পঞ্চাশ টাকা, বলতে বলতে গ্রামের পোষ্টম্যান সাগরময় এসে ঢুকলো ভেতরে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছুটলে যেন। মানি অর্ডার। টেলিগ্রাম নয়, আহঃ। আনন্দে চোখে জল এসে পড়লো দেবেন্দ্রের। মহীন টাকা পাঠিয়েছে, কোথায় টাকা পেল, কি করে পাঠালো কে জানে। কোন খবর নয় এই যথেষ্ট।
: ফর্ম খানা হাতে দিয়ে দেবেন্দ্র বললেন আমারই নামে আছে তো সগর, কোথায় সই করতে হবে, দেখিয়ে দাও।
: আজ্ঞে, চিঠিও আছে একখানা, বলে সাগর একটা পোষ্টকার্ড দিল।
চিঠিখানা আগে পড়লো খোকনের মা। মহীন ভালো আছে। উমেশবাবু তাকে পুত্রবৎ গ্রহণ করেছেন, এই টাকা তিনি পাঠাচ্ছেন খোকনের জন্যে। চাকরিও তিনি একটা করে দেবেন শীঘ্রই।
পঞ্চাশ টাকা একসঙ্গে অনেকদিন দেখেনি দেবেন্দ্ৰ হাত পেতে নোটখানা নিলেন কিন্তু এটা একজনের দান সাহায্য। মহীনের রোজগারের টাকা নয়। যতটা আনন্দ ওর হওয়া উচিত ছিল, তা হোল না। তবু মহীন ভালো আছে সেখানে। আর উমেশবাবু ধনী হয়েও তাদের ভুলে যায়নি এই সান্ত্বনা, খুশীই হলেন তিনি। মহীন লিখেছে খোকনের যেন রোজ আধাসের দুধের ব্যবস্থা করা হয়, ছেলেটা ঠিকমত বাড়িত পারছে না খাদ্যভাবে? হাসলেন দেবেন্দ্র। দুধ স্বপ্নের ব্যাপার তার বাড়িতে। কিন্তু স্বপ্ন কেন? মহীন রোজগার করবে, দুধ অমন অসম্ভব কথা কি?
টাকাগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে আবার শুলেন তিনি খাটে, মাথাটা এখনো ধরে রয়েছে। ডাক পিওন বিদায় হয়ে গেছে, মনি অর্ডার আর কুপন আর চিঠিখানা রয়েছে বিছানার একপাশে। খোকন মার সঙ্গে ভেতর বাড়িতে গেছে। একা দেবেন্দ্র শুয়ে। কিন্তু আর ঘুম। আসে না কত চিন্তা কত অতীতের স্মৃতি কত ভবিষ্যতের স্বপ্ন যে ওর মনের আনাচে কানাচে ঘুরতে লাগলো তার সংখ্যা নেই। নিশ্ৰুপ কিছুক্ষণ পড়ে থাকলেন, তারপর উঠে ভেতরে গেলেন দেয়ালে ধরে ধরে। স্ত্রীকে গিয়ে বললেন একটা টাকা সত্য নারায়ণের পূজার জন্য রাখে, বাকীটা খরচ করো। তোমার একখানা কাপড় বড় দরকার, দয়ালকে ডেকে আনতে পাঠিয়ে দাও।
আচ্ছা, তুমি উঠে এলে কেন?
: কিছু না, এমনি মনটা অস্বস্তি লাগছে।
: কে জানে?
: কেন তা জানে অর্পণা। টাকাগুলো নিতে হলো দারিদ্রের তাড়নায়, নিরুপায় হয়ে, নইলে ক্ষেত্রনাথের পুত্র দেবেন্দ্র কারো অর্থ সাহায্য জীবনে গ্রহণ করেনি। আর এই জন্যই তিনি উমেশবাবুকে কোনো খবর পর্যন্ত দেননি, তার দুঃখ দুর্দশার। মহেন্দ্র জেদ করে গেল, নইলে তাকে ওখানে তিনি পাঠাতেই চাননি। অর্পণা বললো, উনি আমাদের লোকই তো টাকা দিয়েছেন তো ক্ষতি কি? মহীন চাকরী পেলেই আর কারও সাহায্য নিচ্ছি না আমরা, নিজের মনে করে তিনি দিয়েছেন, মনে অশান্তি কেন আনছো তুমি?
অশান্তি নয় অপর্ণা অসহায় বোধ করছি। মহীনের রোজগারের পাঁচটা টাকা এলে আমি হয়তো আনন্দে নাচতাম।
–আসবে? পাঁচ টাকা কেন, পাঁচশো আসবে মহীনের। কত কষ্টে মানুষ করা ছেলে আমার মহীন, সে তো বসে থাকার ছেলে নয় কুড়েও নয়।
: হু, যাক কাপড়টা আনিয়ে নাও, বলে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। অপর্ণ বললো। তোমার তানপুরার তারও আনতে দেব কি রকম তার চাই বলে দাও
–না, অকস্মাৎ ফিরে দাঁড়ালেন দেবেন্দ্র। না অপর্ণা ওটা মহীনের রোজগারের টাকা এলে কিনবে। এই বংশের গৌরববাহী যন্ত্রে আমি পরের দানের স্পর্শ ঘটাব না। চলে গেলেন।
জানে অপর্ণা স্বামী স্বভাব। ভাঙ্গবে তো নুইবে না কঠোর কঠিন সংযমী পুরুষ, নির্লোভ নিরহঙ্কার কিন্তু কোথাও তার বংশগৌরব ক্ষুণ্ণ হতে তিনি দিতে চান না, একান্ত অসহায়। আজ তিনি অন্ধ, অন্ন বস্ত্রহীন, নইলে হয়তো এ টাকা তিনি ফেরত দিতেন।
দয়ালকে ডাকতে হলো না এমনি সে আসে। পাড়ার পরোপকারী যুবক অকাতরে। অপরের জন্য শরীর ব্যয় করতে প্রস্তুত। এসে বললো–
: কাকীমা, কিছু দরকার আছে?
: হ্যাঁ বাবা একখানা শাড়ী এনে দিতে পারবি?
: হ্যাঁ টাকা দাও, আর রেশন কার্ডটা।
অপর্ণা টাকা দিয়ে বললো খুব মিহি কিনিস না বাবা, মাঝামাঝি দেখে আনিস যেন টেকে। খোকনের জন্য প্যান্ট।
আর কি? দয়াল প্রশ্ন করলো!
–না আর কি? একটা রবারের বল পাস তো আনবি খোকনের জন্য দয়াল হয়তো সন্ধ্যা নাগাদ ফিরবে। কিন্তু তানপুরার তারটা কেনা হলো না। হলে উনি বাজাতে পারতেন সকাল সন্ধ্যায় একটা কাজ পেতেন খোকনের শেখা হতো, উপায় নাই। অপর্ণা নিঃশ্বাস ফেলে গৃহকর্মে মন দিল।
খোকন খিড়কী পুকুরের পাড়ে বাগান করেছে। চাপা দোপাটি আর সন্ধ্যামণি ফুলের গাছ লাগিয়ে। কবরী শুলঙ্ক আর গাদা আগে থেকেই ছিল ওখানে। বাগানের মাঝে গোটাকয়েক ভাঙ্গা ইট জড়ো করে বেদী বেঁধেই তার উপর শাহাজাদা বাদশার মতো বসে গান ধরেছে–
কেষ্টঠাকুর কালো হলো, গোরা হলো, গোরা হলো রাধা।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, হঠাৎ শুনতে পেল বাবাকে ডাকতে এসেছে মহামায়া মন্দিরে গান বাজনার আসর থেকে। একছুটে ভিতরে এসে দাঁড়ালো, ও যাবে ওখানে। অপর্ণা ওর ছেঁড়া প্যান্ট খুলে নতুন প্যান্ট পরিয়ে দিল। আনন্দে খোকন চলে গেল বাপের সঙ্গে গান শুনতে।