মিঃ অধিকারী কহিলেন,—সে জিনিস আপনি নিলে আমি কৃতার্থ হয়ে যাবো।
—নিশ্চয়ই নেবো, দিন!
—জিনিসটা কি মিঃ অধিকারী!—প্রশ্ন করিলেন মিঃ ব্যানার্জি।
–একটা ডায়মন্ড রিং। উত্তর দিল তপতী স্বয়ং।
সকলে একটু বিচলিত হইল। বিবাহিতা মেয়েকে আংটি দেওয়া চলে কি? কিন্তু তপতী নিঃসংশয়ে প্রমাণ করিয়া দিতে চায়, সে আজো বিবাহিতনহে এবং এ জন্যই মিস চ্যাটার্জি নামে অভিহিত হইতে আপত্তি করে না। মিঃ অধিকারী ধনীর সন্তান। তিনি তপতীর জন্য আংটি কিনিয়া আনিয়াছিলেন। তৎক্ষণাৎ তাহা বাহির করিয়া তপতীর দিকে অগ্রসর হইলেন। তপতী তাহা পরাইয়া দিবার জন্য বাঁ হাতখানি বাড়াইয়া দিল।
মিঃ অধিকারীর আংটি পরানো তখনো শেষ হয় নাই, মার সঙ্গে তপন আসিয়া ঢুকিল, হাতে তাহার একগুচ্ছ ফুল। মা তপতীর কাণ্ড দেখিয়া মুহূর্তে থহইয়া গেলেন, কিন্তু তপনের
সামনে কোনরূপ উচ্চবাচ্য করিয়া কহিলেন, প্রণাম কর খুকী…
তপতী উঠিল না, যেমন ছিল তেমনি বসিয়া রহিল। তপন একমুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া বলিল,–থাক মা, আমি এমনি আশীর্বাদ করছি। বলিয়া সে অশোক গুচ্ছটি তপতীর হাতে দিতে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ করিল,–তোমার জীবনে পবিত্র হোমশিখা জ্বলে উঠুক…
তপতী পুষ্পগুচ্ছটা টানিয়া ঘুড়িয়া দিয়া সরোষে বলিল,–যাত্রা দলে প্লে করে নাকি? আশীর্বাদের ছটা দেখো!
বন্ধুদল হাসিয়া উঠিল, কিন্তু মা অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন। তিনি কিছু বলিবার পূর্বেই তপন মাকে কহিল—বলুকগে মা, আমি কিছু মনে করিনি।
তপন আপন কক্ষে চলিয়া গেল। মাও অত্যন্ত বিরক্ত এবং বিব্রত হইয়া চলিয়া গেলেন। বন্ধুর দল হাসি থামাইয়া বলিল,–সত্যি একটা ওরাংওটাং।
পরদিন সকালে আসিল শিখা, তপতীর বন্ধুদের মধ্যে নিকটতমা। আসিয়াই বলিল–কাল সবে এসেছি ভাই, তোর বর কোথায় বল—-আলাপ করব।
—আলাপ করতে হবে না, সে একটা যাচ্ছেতাই।
—ওমা, সেকি? কেন?
—যা কপালে ছিল ঘটেছে আর কি। হুঁ, ঠাকুরদা নাকি গণনা করে বলেছিলেন, আমার বর হবে অদ্ভুত, তাই অদ্ভুত হয়েছে, যাত্রাদলের ভড় একটা।
শিখা বিশেষ উৎকণ্ঠিত হইয়া প্রশ্ন করিল—কেন তপু ব্যাপার কিরে?
ব্যাপার তোর মাথা! যা, দেখে আয়, ওঘরে রয়েছে!
শিখা আর কোন কথা না বলিরা তপনের কক্ষদ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। তপন তখন পূজা শেষ করিয়া প্রণাম করিয়া উঠিতেছে। পিছন ফিরিতেই শিখার সহিত চোখ মিলিল। তাহার চন্দনচর্চিত পূত দেহকান্তি, উন্নত প্রশস্ত ললাটে ত্রিপুণ্ডক রেখা, গলায় শুভ্র উপবীত শিখাকে মুহূর্তে যেন অভিভূত করিয়া দিল। শিখা ভুলিয়া গেল, সে দেখা করিতে আসিয়াছে তাহার বন্ধুর বরের সঙ্গে। ভুলিয়া গেল উহার সহিত শিখার সম্বন্ধ কি! যুক্তকর ললাটে ঠেকাইয়া নমস্কার করিতে গিয়া শিখা আভূমি লুষ্ঠিত হইয়া তপনকে প্রণাম করিয়া বসিল।
মৃদু হাসিয়া তপন কহিল,—তুমি কে ভাই দিদি? এ সমাজে তোমাকে দেখবার আশা তো করিনি?
পাঁচ সাত সেকেণ্ড করোধ হইয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে সে কহিল—আমি আপনার ছোট বোন আর তপতীর বন্ধু আর জাষ্টিশ মুখার্জির মেয়ে।
-ওঃ! তুমিই শিখা। কিন্তু একটা কথা আছে।
বলুন!
—এখানে আমাকে তুমি কেমন দেখলে, কিছুই বলবে না তোমার বন্ধুর কাছে কারো কাছে। আজ বিকেলে আমি তোমাদের বাড়ী গিয়ে যা-কিছু বলবার বলবো-অনেক কথা আছে। তুমি এখন বাড়ী চলে যাও ভাই শিখা।
–যাচ্ছি। কিন্তু আমার নাম জানলেন কি করে?
–মার কাছে শুনেছি। আচ্ছা, এখন আর কথা নয়।
শিখা বাহিরে আসিয়া আপনার গাড়ীতে উঠিয়া প্রস্থান করিল, তপতীর সহিত আর দেখাও করিল না।
০৩. তপনের অভ্যর্থনার জন্য
তপনের অভ্যর্থনার জন্য শিখা পরিপাটি আয়োজন করিয়া রাখিয়াছে। কয়েক মিনিটের দেখা তপনের কথা শিখা আজ সারাদিন ভাবিয়াছে। আশ্চর্য ঐ মানুষটি। মুহূর্তে যে এমন করিয়া আপন করিয়া লইতে পারে, তপতী তাহার সম্বন্ধে কেন ওরূপ কথা বলিল! শিখা সমস্ত দিন ভাবিতেছে ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু রহস্য আছে। তপতীর বিবাহের গোলযোগের কথা ভাগলপুরে থাকিতেই সে শুনিয়াছিল তার মার চিঠিতে। আজ তপতীর সেই বরকে দেখিয়া সে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছে। শিখারা দুই বোন, দাদা বা ছোট ভাই নাই,তপন যদি শিখার দাদা হয়,—শি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল,–হ্যাঁ, হইয়াছেনই তো।
তপতীরসহিত ফিরিবার সময় দেখাৰাকরিয়া আসাটা ভালো হয় নাই।কিন্তু উনি যেবারণ করিলেন।ওঁরকথায় অবাধ্য তো হওয়া যায়না।তপতীরাগকরেকরুক—তাহার ভাবকরিতে বেশী দেরী হইবে না। ব্যাপারটা তো শোনা যাক দাদার মুখ হইতে।
তপন আসিয়া পৌঁছিল। পরনে অফিসের পোশাক, হ্যাট-কোট-প্যান্ট। শিখা আগাইয়া যাইতে হাসিমুখে বলিল, চিনতে পাচ্ছিস ভাই, দিদি?
-চিনিবার তো কথা নয় যা ভোল বদলেছোবদলেছেন।
–থাক, আর ছেন জুড়তে হবে না। দুজনেই হাসিয়া উঠিল। শিখা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলিল,–কখন যে মনের মধ্যে দাদার আসনখানি জুড়ে বসেছো, টেরই পাইনি। নিজের অজ্ঞাতসারেই তুমি বলে ফেললাম।
তোর কাছে এমনটাই আশা করছিলাম ভাই। চল, বাবা মাকে প্রণাম করি গিয়ে।
উচছুসিত আনন্দে শিখা তপনকে ভিতরে আনিয়া তাহার মা-বাবার সহিত পরিচয় কাইয়া দিল। তপন হেঁট হইয়া তাহাদের প্রণাম করিয়া উঠিয়াই বলিল,–আমি নিজে নিমন্ত্রণ নিয়েছি কাকীমা, আপনার দুষ্টু মেয়ে নিমন্ত্রণ করেনি।
হ্যাঁ, করেনি–নিমন্ত্রণ করবার সুযোগ দিয়েছিলে? যাওয়া মাত্র তাড়িয়ে ছাড়ল মা। এত্তো দুষ্টু!