পরদিন তপন একটা মোটর বাইকে চড়িয়া বাড়ী ফিরিল।
পরীক্ষার জন্য তপতী কিছুদিন যাবৎ অত্যন্ত ব্যস্ত তাই তাহার সঠিক স্বরূপ তপন দেখিতে পাইতেছে না। তথাপি সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছে, তপতীর নিকট তপনের কোন আশা নাই। তপতী তাহার বন্ধুদের মধ্যে কাহাকেও নিশ্চয় ভালোবাসে, কিম্বা এমনও হইতে পারে, তপতী আজো কাহাকেও ভালবাসিবার সুযোগ পায় নাই, তবে তপনকে যে
সে কোন দিন গ্রহণ করিবে না, ইহা নানা ভাবে বুঝাইয়া দিতে চায়।
আজও তপন বাহির হইবার পূর্বে তাহার মোটর বাইকখানা লইয়া সেই যে তপতী লনের চক্রাকার পথে ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে; নামিবার নামটি নাই। তপন নীরবে গেটের নিকট মিনিটখানেক দাঁড়াইল,—ভাবটা,—তাহাকে দেখিয়া যদি তপতী বাইক খানা ছাড়িয়া দেয়। তপন পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে, তপতী বাইকের বিকট শব্দ করিয়া বাহির হইয়া গেল একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে। অর্থাৎ এবাড়ীর সব জিনিসেই তপতীর অধিকার, তপনের কিছুমাত্র অধিকার নাই। তপন হাঁটিয়া গিয়া ট্রামে উঠিল। তারপর সে সনাতন ট্রামেই যাতায়াত আরম্ভ করিয়া দিল।
মা কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা জানিতে পারিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধস্বরে মেয়েকে বলিলেন,—এসব তোর কি কাণ্ড খুকী!
উচ্ছল হাসিতে ঘর ভরাইয়া তুলিয়া খুকী জবাব দিল,–জানো মা মোটর গাড়ী সব মেয়েই চালায়, কিন্তু মোটর বাইক চালাতে বেশী মেয়ে জানে না—আমি তাদের হারিয়ে দিলাম।
মা খুশী না হইয়া বিরক্তির সঙ্গে বলিলেন,—তোর বাবাকে বল, তোর জন্যে একখানা কিনে দিক; ওরটা কেন নিলি?
—নিলুম, তাতে তোমার জামাই ধন্য হয়ে যাবে বুঝেছো! তপতী হাসিয়া আপন কক্ষে চলিয়া গেল একটা ইংরেজী গানের এক লাইন গাহিতে গাহিতে।
খুকীর মন তপনের প্রতি অনুকূল না প্রতিকুল! আপনার গর্ভজাত কন্যার অন্তররহস্য মা আজ কিছুমাত্র অনুধাবন করিতে পারিতেছেন না। তাহাদের সময়ে এসব ছিল না। ধনী শ্বশুবের আদরিণী পুত্রবধূ হইয়া তিনি আসিয়াছিলেন প্রথম দর্শনের দিনটি হইতেই স্বামীকে আপনার বলিয়া চিনিয়াছিলেন, স্বামীও তাঁহাকে আপনার করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু এযুগের আবহাওয়া কখন কোন দিক দিয়া প্রবাহিত হয় তাহা বুঝিবার সাধ্য স্বয়ং মহাকালের
আছে কিনা সন্দেহ। উহা লতপন বাড়ী ফিরিলে তিনি উৎকণ্ঠিত ভাবেই প্রশ্ন করিলেন, ট্রামেই তো এলে বাবা–
-হ্যাঁ মা। কিন্তু আপনি এত ভাবছেন কেন! ট্রামে বিস্তর বড়লোকের ছেলে চড়ে। ট্রাম কিছু খারাপ নয় মা।
মা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। দরিদ্র এই ছেলেটি নিজেকে দরিদ্র বলিয়া প্রচার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। এখনি হয়ত বলিয়া বসিবে, আমি ফুটপাতের মানুষ মা, আপনার আবুহোসেনি রাজত্বে এসে নাই বা চড়লাম মোটরে। রাজত্ব তো রয়েছে! আর ইহাকে দেওয়া জিনিস যখন তাহারই মেয়ে কাড়িয়া লইয়াছে তখন বেশী কিছুবলিতে যাওয়া উচিত নয়। হয়ত মনে করিবে, নিজের মেয়েকে বলিতে পারেন না, যত কথা তাহাকেই বলা হয়। উহার ভালোমানুষির সুযোগ লইয়া খুকী কিন্তু বড়ই অন্যায় করিতেছে। একটু ভাবিয়া বলিলেন—খুকীর গাড়ীটাই বা কেন তুমি নাও না বাবা?
–গাড়ীর দরকার নেই মা, অনর্থক কেন ভাবছেন আপনি! আর দরকার যখন হবে তখন নেবো, ও নিয়ে আর মাথা ঘামাবেন না। আমরা বুঝব সে সব!
মা ভাবিলেন, হয়তো তাহাই ঠিক,–খুকীর সহিত তপনের কোনরূপ কথাবার্তা হইয়া থাকিবে। তিনি আর উচ্চবাচ্য করিলেন না।
আহারান্তে তপন চলিয়া যাইতেছিল, মা বলিলেন,–খুকীর জন্মদিন বাবা, আজ একটু সকাল সকাল ফিরো!
–চেষ্টা করবো মা। বলিয়া তপন চলিয়া গেল।
সন্ধ্যায় বাড়ীতে মহাসমারোহ! আধুনিক সমাজে বিবাহের পূর্বেই অবশ্য মেয়ের জন্মদিনউৎসব ধূমধামে হইয়া থাকে, বিবাহের পর উহার প্রয়োজন ফুরাইয়া যায়! কারণ, জন্মদিনউৎসবটা ছেলেদের ও মেয়েদের পরস্পর পছন্দ করিয়া বিবাহ বন্ধনের জন্য প্রস্তুত হইবার দিন! কিন্তু তপতী ইহাদের একমাত্র কন্যা, তাই জন্মদিনটা এবারও হইতেছে।
তপতীর বন্ধুর দল তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। গান গাহিতেছে একটি মেয়ে! বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তপতীকে আশীর্বাদ করিয়া গেলেন। অনেকে মিসেস চ্যাটার্জিকে জামাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। মিসেস চ্যাটার্জি প্রত্যেককে জানাইলেন, সে জরুরী কাজে গিয়াছে, এখনি আসিবে।
মিসেস চ্যাটার্জির কথায় মিঃ অধিকারী কহিলেন—সেই বামুন ঠাকুরটি কোথায় গেলেন? ভয়ে পালিয়েছেন নাকি?
মিঃ ব্যানার্জি উত্তর দিলেনভয় নয় ভাবনায়, আমরা তার বোকামী ধরে ফেলবো বলে!
মিঃ চৌধুরী বলিলেন—রেবা দেবী সেদিন তার টিকি কেটে দিয়েছেন। রেবা দেবী কহিলেন,—মাথাটা মুড়ানো আছে, তুই ঘোল ঢেলে দিস তপতী।
-না না না মিস চ্যাটার্জি, ঘোল নয়, ওর মাথায় কডলিভার অয়েল দেবেন, চুলগুলো একটু ভিটামিন খেয়ে বাঁচবে।
সকলেই হাসিয়া উঠিল। মিস চ্যাটার্জি আখ্যাতা তপতী কহিল,–চুপ করুন, মা শুনতে পেলে বকবেন এখুনি।
–বকবেন কি? এর জন্য দায়ী তো আপনার মা আর বাবা! আপনার মতো সর্বগুণান্বিতা মেয়েকে একটি বানরের গলায় দিতে ওঁদের বাধলো না?
তপতী চুপ করিয়া রহিল। ক্ষণ পরে কহিল—মিঃ ব্যানার্জি তত আমায় দুল দিয়েছেন, মিঃ চৌড্রী দিলেন ব্রোচ, মিঃ অধিকারীর কথা ছিল যা দেবার তা না দিয়ে অন্য একটা বাজে জিনিস দিলেন, ওঁর শাস্তি হওয়া দরকার।
সকলেই একসঙ্গে বলিয়া উঠিল,–সার্টেনলি।