কিন্তু পরদিন মিঃ চ্যাটার্জি তপনের জন্য একখানা গাড়ী কিনিয়া আনিলেন। তপন পরদিন নূতন গাড়ী চড়িয়া অফিসে গেল। বিকেলে ফিরিয়া গাড়ীখানা গাড়ীবারান্দায় রাখিয়া সে জল খাইতে বসিয়াছে, তপতী দেখিল, নূতন গাড়ীখানা দেখিতে খুবই সুন্দর সে অন্য সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া গাড়ীটাকে লইয়া বেড়াইতে চলিয়া গেল। তপন নীচে আসিয়া দারোয়ানের মুখে দিদিমণির কীর্তি শুনিয়া মৃদু হাসিল এবং ট্রামের পাশখানা পকেটে ঠিক আছে দেখিয়া লইয়া হাঁটিয়া গিয়া ট্রামে উঠিল।
রাত্রে ফিরতেই মিসেস চ্যাটার্জি বলিলেন,–খুকীটা বড্ড দুই বাবা, তোমার গাড়ী নিয়ে বেড়াতে চলে গিয়েছিল। আবার বকতে গেলুম, তো হাসে।
—নিক না মা; ছেলেমানুষ, ঐ গাড়ীটা যদি ওর ভাল লাগে তো নিক—আমি ট্রামে বেশ যাতায়াত করতে পারি।
বাবা, তুমি এমন কিছু বুড়ো মানুষ নও। আর খুকীর ত গাড়ী রয়েছে। তুমি দিওনা ওকে তোমার গাড়ী।
উত্তরে তপন মৃদু হাসিল, কিছুই বলিল না। খাইতে খাইতে সে ভাবিতে লাগিল, তপতীর ইহা নিছক ছেলেমানুষি, নাকি ইহার অন্তরালে আরো কিছু আছে? এই দীর্ঘ পনেরদিন একটিবারও তপনের সহিত তাহার দেখা হয়নাই। দুজনেই দুজনকে এড়াইয়া চলিয়াছে; হঠাৎ তাহার জন্য ক্ৰীত গাড়ীখানা লইয়া তপতীর বেড়াইতে যাইবার উদ্দেশ্য কি? সে কি চায় যে তপন তাহার সহিত মিশুক, তাহার সহিত বেড়াইতে যাক—কিম্বা তাহার বিপরীত। তপন কিছুই স্থির করিতে পারিল না। খাওয়া শেষ করিয়া আপনার কক্ষে গিয়া শয়ন করিল।
কিন্তু ঘুম কি আসিতে চায়। তপতী তাহার পঞ্চবিংশতি বর্ষের জীবনে জ্বালাইয়া দিয়াছে। তপন এই কয়দিন লক্ষ্য করিয়াছে, যাহাদের সহিত তপতী বেড়াইতে যায়, গানকরে, টেনিস খেলে, তাহারা সকলেই আধুনিক সমাজেরতরুণ-তরুণী।সুশ্রী, সভ্য এবংসর্বতোভাবে তপতীর যোগ্য। এত লোককেছাড়িয়া কেন মিঃ চ্যাটার্জি তপনেরসহিতকন্যার বিবাহ দিলেন, তপন তাহা ভাবিয়া পায় না, তাহার পিতার সহিত নাকি মিঃ চ্যাটার্জির বন্ধুত্ব ছিল। তপন যখন নিতান্ত ছোট তখনই নাকি মিঃ চ্যাটার্জির কন্যার সঙ্গে তপনের বিবাহের কথা হয়। কিন্তু মিঃ চ্যাটার্জি সেকথা ভুলিয়াইবারহিলেন কেন, আর আজ এতকালপরে সেইঅঘটনটা ঘটাইয়াই বা দিলেন কেন। কিন্তু ভাবনা, নিল। যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে।
সকালে উঠিয়া স্নান পূজা যথারীতি সারিয়া সে বাহিরে যাইবার জন্য আজো তাহার গাড়িখানি লইতে আসিয়া দেখিল, তাহারই গাড়ী লইয়া তপতী প্রাতঃভ্রমণে বাহির হইয়া গিয়াছে, এখনো ফিরে নাই। তপতীর গাড়ীটা অবশ্য গ্যারেজেই রহিয়াছে, কিন্তু তপনের উহা লইতে সঙ্কোচ বোধ হইল। শুধু সঙ্কোচ বলিলে যথেষ্ট হয় না, হয়তো একটু ঘৃণার ভাবও মনে আসিল তাহার। কতদিন তপন দেখিয়াছে, ঐ গাড়ীখানার চালকের স্থানে তপতী এবং পাশে মিঃ ব্যানার্জী না হয় মিঃ অধিকারী কিম্বা চৌধুরী-কোনদিন বা তিনজনই। ও গাড়ী না লওয়াই ভালো। তপন ট্রাম ধরিবার জন্য বাহির হইয়া গেল।
তপতী বাড়ী ফিরিয়া দেখিল, তাহার টু-সীটার গ্যারেজে রহিয়াছে। চাকরকে জিজ্ঞাসা করিল,জামাইবাবু গাড়ী নেহী লিয়া?
নেহী হুজুর—ট্রামমে চলা গিয়া।
তপতী উপরে চলিয়া আসিল এবং নিঃশব্দে আপন ঘরে ঢুকিয়া পড়িতে বসিল; মা কিন্তু সমস্তই জানিয়াছেন;কন্যার ঘরে আসিয়া একটু উত্তপ্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন করিলেন,–খুকী, আজও তুই ওর গাড়ী নিয়েছিলি?
—নিলুম তো কি হলো মা? ও আমার গাড়ীটায় চড়লো না কেন? বলে দিও ঐটা নিতে। এ গাড়ীটা বেশ দেখতে, তাই নিয়েছিলুম। এই গাড়ীটাই আমি নেবো এবার থেকে।
মা বিস্ময়ের সহিত বলিলেন,–কেন, তোর গাড়ী মন্দ?
-মন্দ কেন—এটা নতুন, বেশ রংটা আর দৌড়ায় খুব। কিন্তু আমার গাড়ীটাও খারাপ নয়-চড়ে দেখতে বললা একদিন।
তপতীমধুর হাসিল। মা ভাবিলেন, খুকীতাহার জামাতার সঙ্গে ভাব করিতে চায়। বয়স্কা মেয়ে, লজ্জায় সব কথা খুলিয়া বলে না, আর এ-যুগের মেয়েদের চিনিবার উপায় নাই। হয়ত খুকী তপনের সঙ্গে কথাবার্তা কিছু কহিয়াছে,হয়ত ইহা ভালোরই লক্ষণ। মা খানিকটা স্বস্তির হাসি হাসিয়া বলিলেন,–বেশ তো, দুজনে বলাবলি করিস।
-হ্যাঁ, তুমি বলে দিও সে কথা!
তপতী পাঠে মন দিল। মা চলিয়া আসিলেন। দুপুরে তপন খাইতে আসিলে মা বলিলেন,–তুমি খুকীর গাড়ীটাই নাও বাবা, তোমার গাড়ীর সবুজ রং ওর বড় পছন্দ হয়েছে, তাই তোমারটাই নিতে চাইছে।
—বেশ তো মা, ও নিক—গাড়ীর আমার কী-ই বা দরকার? তখনও যেমন চলছিলাম, এখনও তেমনি চলবো ট্রামে।
—না বাবা-মা। মা ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। তাহলে আমি খুকীর কাছ থেকে গাড়ীটা কেড়ে নেব।
ছিঃ মা, ওর এখন পড়ার সময়, মনে আঘাত পাবে। আমি কিছু মনে করছি না মা, দুটো গাড়ীই থাকলো, যখন যেটাতে খুসি ও চড়বে।
-তুমি তাহলে কি ট্রামেই চড়বে বাবা? মাতার স্বরে আতঙ্কের আভাস স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিল।
হাসিয়া তপন বলিল—আচ্ছা মা, আমি একটা মোটর বাইক কিনে নেবো।
–বড্ড বিপদজনক গাড়ী বাবা–ভয় করে।
—কিছু ভয় নেই মা, আমার জীবনে কোন অকল্যাণ স্পর্শ করে না।
মা খানিকটা আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন,—মেয়েটার কি যে কাণ্ড।
–আপনার খুকীর গাড়ী না হলে একদিনও চলে না, আর আমার পা-গাড়ীতে আমি পঁচিশ বছর চলে এলুম। আমার জন্য অত ভাবছেন কেন মা! তাছাড়া মোটর বাইকে চড়তে আমি ভালোবাসি।
–বেশ বাবা, তাই করো তাহলে আজই কিনে নাও একখানা মোটর বাইক। খাওয়ার শেষে আপন কক্ষে আসিয়া তপনের হাসি পাইতে লাগিল। প্রাচুর্যের মধ্যে যাহাদের বাস তাহারা অর্থ সম্পদ দিয়াই মানুষকে বশ করিতে চায়। কিন্তু মানুষ যে অর্থের অপেক্ষা অন্য একটা জিনিসের বেশী আকাঙ্ক্ষা করে, তাহা ইহারা কিরূপে জানিবে? যাক, মোটর বাইক একখানা কিনিতেই হইবে নতুবা মা ভাবিবেন, খুকীর উপর তপন রাগ করিয়াছে।