তপতী কহিল, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও যারা সম্মুখযুদ্ধে পিছোয় না, যেমন আপনি।
আমি! তাহলে কাপুরুষটি কে আবার?
তপনের দিকে আঙুল তুলিয়া কহিল,–ঐ ইডিযট, ঐ ভণ্ড, ঐ জোচ্চর।
সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিতেছে। মিঃ রায় আনন্দিত হইতে গিয়াও যেন ধোঁকায় পড়িয়া কহিলেন,—ছিঃ ছিঃ, মিস চ্যাটার্জী, কি সব বলছেন আপনি?
আপনাকে বারণ করেছি না আমায় মিস চ্যাটার্জী বলতে? বলবেন না আর।
কিন্তু আপনি ওকে অত্যন্ত অপমান করছেন, মিস চ্যাটার্জী…
মিঃ রায় বাধা পাইলেন। তপতী সজোরে ধমক দিল, শাট আপ! ফের মিস চ্যাটার্জী?
তপতীর উচ্চকণ্ঠ শুনিয়া মা তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিলেন, খুকী হয়তো তপনের সহিত কিছু একটাকাণ্ড বাধাইযাছে।তাহাকে দেখিয়া তপনকুণ্ঠিত স্বরেকহিল—ওঁরাঅতিথি,ওঁদের অসম্মান করতে নেই। মা, ওঁকে বারণ করুন!—তপন মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিল মার পানে।
অকস্মাৎ তপতী চেয়ার ছাড়িয়া আসিয়া তাহার সুদীর্ঘ বেণীটাকে চাবুকের মতো ব্যবহার করিল তপনের বাম বাহুতে—সপাৎ সপাৎ! চীৎকার করিয়া বলিল,—ওরা তোমার অতিথি, তুমি ওদের সম্মান করবে…আর তোমার বিবাহিতা পত্নীকে ওরা বার বার অসম্মান করবে মিস, বলে নিশ্চিন্ত বসে দেখবে তুমি…কেন? কিসের জন্য বলোতপতী আবো একটা আঘাত করিল সজোরে।
এই অকস্মিকতার আঘাতে নিথর হইয়া গেছে রঙ্গভূমি। তপনের সুগের বাহুতে প্রত্যেকটি আঘাত রক্তলেখায় ফুটিয়া উঠিতেছে। মা কষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া কহিলেন—কি তুই করলি, খুকী।
ক্রোধ-কম্পিত তপতী চাহিয়া দেখিল তপনের শোণিতাক্ত বাহু! উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে তাহার সীমান্ত লুটাইয়া পড়িল সেই রক্তের উপর—তপতী যেন আজ ঐ রক্ত দিয়াই তাহার শুভ্র সীমান্ত রঞ্জিত করিয়া লইবে! অরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল,–বড় জ্বালা করছে না?
তপতীর আকুল কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট নিরুপায় তপন নির্লিপ্তর মতোই যেন বলিল,–এমন কিছু না। কাদবার কি হয়েছে? সেরে যাবে—তারপর তপতীর মাথাটি সস্নেহে তুলিয়া ধরিয়া মাকে বলিল,–মা, ধরুন ওকে,—পড়ে যাবে এখুনি
মা গিয়া তপতীকে ধরিলেন। তপতী থর-থর করিয়া কাপিতেছে! একটা নীরব নমস্কার জানাইয়া তপন ধীরে ধীরে চলিয়া যাইবে—তপতী ছুটিয়া গিয়া তাহার পথরোধ করিল,—যাচ্ছ যে?
—আমি তোমায় মুক্তি দিয়েছি, তোমায় গ্রহণ করবার সাধ্য আর আমার নেই। বিস্ময়ে তপতীর চক্ষু বিস্ফারিত হইল—মুক্তি দিয়েছো?
—হ্যাঁ। আমার সত্য বজ্রের চেয়ে কঠোর, মৃত্যুর চেয়ে নিষ্ঠুর। সত্যভঙ্গ করে তোমায় আমার সহধর্মিণীর আসনে আর বসাতে পারবো না—
তপন চলিয়া যাইতেছে। কিন্তু বিমূঢ়া তপতী পড়িয়া যাইবে, তপন ক্ষিপ্রহস্তে তাহাকে ধরিয়া স্নেহের শীতলতম মাধুর্যে কহিল,—এতদিন পরে এমন করে কেন তুমি আজ এলে তপতী? তুমি মুক্ত বিহঙ্গের মতো নীল আকাশের বিপুল বিস্তারে পাখা মেলো—আমার ধরার ধুলিতে পড়বে এসে তার ছায়া—একটি মুহূর্তের তরে যেখানে তুমি গ্রহণ করলে তোমার আসন! মুক্তির সেই অবাধ অধিকারে রইল আমাদের চিরমিলনের আকুতি…
তপন চলিয়া গেল।
অকস্মাৎ তপতীর আর্ত চীৎকারে দিগপ্রান্তধ্বনিত হইয়া উঠিল,–ঠাকুরদা-ঠাকুরদা… দিন, মাস, বর্ষ চলিয়া যাইতেছে…
বিশাল তপতী নিবাসে, তপনের পরিত্যক্ত কক্ষটিতে বসিয়া থাকে তপতী—একা, আত্ম-সমাহিত কুষ্ঠিত পিতা আসিয়া বলেন—তোর আবার বিয়ে দেবো, খুকী, তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে…
নিয়তির মতো নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যে তপতী উচ্চারণ করে-তাই বুঝি ঠাকুরদার সৃষ্ট দেবমূৰ্ত্তিকে দানবী করে তুলেছিলে? কিন্তু ওর নিষ্ঠুর ছেীর আঘাতে আবার তাকে দেবী করে দিয়ে গেছে বাবা!—এ-মন্দিরে আর কারও প্রবেশ নেই।—যাও।
স্নেহ-দুর্বল পিতা পুনরায় বলেন আমার কাছে দুলাখ টাকা নিয়ে আমারই বাবার নামে শ্যামসুন্দর ভিক্ষুকাশ্রম করেছে, এতেবড়ো হৃদয়বান সে! খুকী, চল্ ওকে ডেকে আনি।
হাস্যদৃঢ় কণ্ঠে তপতী উত্তর করে,—ওর সহধর্মিণী আমি হয়েছি, বাবা, সত্যভঙ্গ করিয়া বিলাস সঙ্গিনী হতে আর চাইনে!
মা আসিয়া স্নেহ-সজল স্বরে কহেন,—এমন করে কতদিন তুই থাকবি খুকী?
তপতী স্নিগ্ধ ঔদার্য্যে আত্মপ্রকাশ করে,—এমনি করে আমরণ রাখবো আমার বিরহের চিতা বহ্নিমান!
গভীর নিস্তব্ধ নিশীথে তপনের শূন্যশয্যা-প্রান্তে নতজানু তপতীর করুণ মধুর কণ্ঠঝঙ্কার শোনা যায় :
—তোমায়-আমায় মিলেছি, প্রিয়, শুধু চোখের জলের ব্যবধানটুকু রইল।