তপতী হু হু করে কাঁদিয়া ফেলিল। বিস্ময়-সমুদ্রে নিমজ্জিত মিঃ রায় নির্বাক হইয়া গেলেন। তপতী আত্মসম্বরণ করিয়া কহিল,—বিকালে আসবেন, মিঃ রায়! ও আসবে সেই সময়। আর শুনে রাখুন, ওকে আমি আজও ভালবাসি, আমার শিরার শোণিতের মতো-বুকের স্পন্দনের মতে,—জীবনের যাতনার মতো।
তপতী চলিয়া গেল অন্যত্র। মিঃ রায় মিনিটখানেক দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। বুঝিলেন, তপতী তাঁহার আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।
বিকালে সুসজ্জিতা তপতী বেণী দোলাইয়া বসিয়া রহিল তপনের অপেক্ষায়। কয়েকটি নারী এবং পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে মিঃ রায়ও শেষ চেষ্টা দেখিতে আসিয়াছেন। তপতী বললে,–ওকে যে ঠকাতে পারবে, তাকে পুরস্কার দেবো।
সলিলা বলিল,–ভারি তো! একটা পুরুষকে ভেড়া বানাতে কতক্ষণ লাগে?
মাধুরী বলিল,–অত্যন্ত সহজে জব্দ করে দিচ্ছি-দাঁড়া।
মিনতি বলিল,–পদ্মবনে পথভ্রান্ত পথিক করে ছাড়বো ওকে। কাটার ঘায়ে মূর্চ্ছা যাবে।
তপতী বলিল,–ও কিন্তু তপন, পদ্মরাই ওর পানে চেয়ে থাকে।
মিঃ রায় দ্রুকুটি করিলেন তপতীর শ্রদ্ধাভরা কথা শুনিয়া। বলিলেন,–গোলাপবাগে গুবরে পোকার মতো করতে পারলে তবে জানি।
তপতী মিঃ রায়ের অন্তরের ঈর্ষা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, গোলাপবাগের ও গোপন মধুকর, গুবরে পোকার মতো ও ভ্যাভ্যানায় না! ও থাকে গোপন অন্তঃপুরে!
এমনভাবে কথা বলিতে পারিয়া তপতী যেন অত্যন্ত তৃপ্ত হইয়া গিয়াছে, এমনই দেখাইতেছে তাহার চোখ দুটি। আপনার অজ্ঞাতসারেই তাঁহার কণ্ঠে যেন আজ তপনের ভাষার মাধুরি ঝরিতেছে। ইহাই কি বৈষ্ণব সাহিত্যের অনুখন মাধব সোঙরিতে সুন্দরী ভেলি মাধাই।
মিঃ রায় বিপদ বুঝিয়া কথা বন্ধ করিয়া দিলেন।
তপন আসিয়া প্রথমেই বাড়ি ঢুকিয়া মিঃ চ্যাটার্জী ও মিসেস চ্যাটার্জীর পাবনা করিল। অতঃপর সকলকে বিনীত নমস্কার জানাইয়া আসনে বসিল।
প্রথমালাপের পর সলিলা বলিল, আপনার কথা অনেক শুনেছি, চোখে দেখে মনে হচ্ছে আপনি যাদুকর।
—আমার ভাগ্যটাকে অন্যের ঈর্ষার বস্তু করে তুলবেন না, মিস গুপ্তা, জগতে যাদুকরের আদর এখনও রয়েছে।
কিন্তু আপনিই-বা অনাদৃত কিসে?
-না–তবে, আদরটা আমার সহ্য হয় না-তুষারের পরে যথা রৌদের আদর উত্তপ্ত বালুতে যথা আদর অশ্রুর।
কথাটার কোথায় যেন বেদনার ইঙ্গিত রহিয়াছে। একটা হাসির কিছু আলোচনা হইলেই ভালো হয়। মাধুরী বলিল, ওসব কথা থাক, চায়ের মজলিসে হাসির গল্পই জমে ভালো।
মিঃ রায়ের পটুতা এ-বিষয়ে সর্বজনবিদিত; কহিলেন, রাইট, হাসি সব সময়ে কাম্য।
অন্যপ্রান্ত হইতে তপতী কহিল, সবারই মন সমান নয়। মানুষকে মানুষ করতে কান্নাই সক্ষম। আপনার মতটা কি বলুন তো? তপতী সাগ্রহে চাহিল তপনের পানে।
বিস্মিত তপন ভাবিয়া পাইলনা, তপতী তাহাকে লইয়া আজ কী খেলা খেলিবে। তপতী আজ অত্যন্ত দুর্বোধ্য। মৃদুহাস্য সহকারে সেকহিল ওঁর মতটাকেই তো প্রাধান্য দেওয়া উচিত আপনার।
সুমিষ্ট একটা ধমক দিয়া তপতী কহিল, চুপ। আমার মত কারও মতের অপেক্ষা রাখে। আমার মত আমার স্বাতন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত, মুক্ত স্বাধীন,বলুন এবার আপনারটা
আরো বিস্মিত হইয়া তপন ধীরে ধীরে কহিল, আমার মতে, হাসির মধ্যে কান্না আর কান্নার মধ্যে হাসিকে দেখতে শেখাই কাম্য। পৃথিবীর তিনভাগ অশ্রু-সাগর মাত্র এক ভাগ হাসির দ্বীপপুঞ্জ। আপাতদৃষ্টিতে মনোরম কিন্তু কুমীরের মাঝে মাঝে জল থেকে উঠে আসার মতো আনন্দদায়ক হলেও অস্বাভাবিক। হাসির প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু কান্নার প্রয়োজন ততোধিক, আনন্দ থেকেই হাসির উদ্ভব, কিন্তু গভীরতম আনন্দ কান্নাতেই প্রকাশ পায়। তাই মনে হয়, হাসি-কান্নাতে মূলত কোন তফাত নেই।
মিনতী বলিয়া উঠিল, বড্ড দার্শনিক প্রবন্ধের মতো শোনাচ্ছে। সহজ হাসি চাইছি আমরা।
তপন বলিল,–সহজ কথাটা পাত্রভেদে বদলায়। যেমন কাঠবিড়ালের গাছে ওঠা আর উদবিড়ালের জলে নামা।
মিনতী পুনরায় কহিল—অর্থাৎ আপনি বলতে চান, আমাদের চেয়ে আপনি উৎকৃষ্ট পাত্র?
তপন কহিল, উৎকৃষ্টতার প্রশ্ন অবান্তর। পৃথিবীর কাঞ্চনের প্রয়োজন থেকে কাচের প্রয়োজন কম নয়। এমন কি, ক্ষুদ্র কেঁচোরও প্রয়োজন আছে।
মুখ-টেপা হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল তপতী। কাচ-ভ্রমে সে তপনকে অগ্রাহ্য করিয়াছে। সে কহিল, আছে, কাগজি লেবু থেকে আরম্ভ করে কাঁচকলার অবধি প্রয়োজন আছে।
সকলেই মৃদুস্বরে হাসিতেছে। তপনের ভাষাটাকে এভাবে অনুকরণ করিয়া তপনকে সমর্থন করার জন্য মিঃ রায় ক্ষুন্ন হইতে গিয়া কথার হুল ফুটাইয়া ফেলিলেন। কহিলেন, কাচপোকারাওকেমন?
তপতীর দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া উঠিল। আপনার অজ্ঞাতসারেই সে আজ তপনকে অনুসরণ করিতেছে—কিন্তু মিঃ রায় যে ইহা সহিতে পারিতেছেন না, তাহা বুঝিতে তপতীর মুহূর্ত বিলম্ব হইল না! কহিল, হ্যাঁ,কাচপোকাও ভালো যেমন ভালো কাচের কুঁজোর জলের থেকে কৃষ্ণসাগরের কালো জল।
তপতীর এই উচ্ছ্বাসময় বাণী বিহ্বল করিয়া গিয়াছে সকলকেই। তপন সমই বুঝিল। তাহার দৃষ্টি নিবিড় বেদনায় নির্নিমেঘ হইয়া উঠিয়াছে। মৃদুস্বরে কহিল,ককারে কথা কলঙ্কিত হয়ে উঠেছে তপতী দেবী।
মৃদু হাসিয়া তপতী উত্তর দিল, কাপুরুষের গায়ে কাদাই ছিটানো উচিত। তাহাকেই কাপুরুষ বলা হইতেছে ভাবিয়া মিঃ রায় ক্রোধ সম্বরণ করিয়া কহিলেন,কাপুরুষের উল্টো লোকটি কে এখানে, মিস চ্যাচার্জী?