মিসে চ্যাটার্জি স্বামীর কক্ষে আসিলেন। মিঃ চ্যাটার্জি এখনও তাহার অপেক্ষায় জাগিয়া ছিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন,–খুকী ফিরেছে?
-হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরলো।
মিঃ চ্যাটার্জি নিদ্রার আয়োজন করিতেছেন। মিসেস চ্যাটার্জি কয়েক মিনিট থামিয়া বলিলেন,–খুকী কিন্তু তপনকে মোটেই পছন্দ করছে না।
বিস্ময়ের সুরে মিঃ চ্যাটার্জি কহিলেন,—কেন! অপছন্দের কি কারণ?
ছেলেটাকে আমার তো খুব ভাল লাগছে গো, তবে লেখাপড়া ভালো জানেনা, পাঁচালী, ছড়া, এইসব নাকি পড়ে। খুকী তো এই কদিনে একবারও তার কাছে যায়নি। কতবার বললাম, জ্বর হয়েছে, একবার যা, কাছে গিয়ে বোস, তা কথাই কানে তুললো না। আজ আবার এসে বললো, তার বন্ধুরাও যেন ওর কাছে না যায়। আমি বাবু বেশ ভালো মনে করছি না, অতবড় মেয়ে!
পত্নীর এতগুলি কথার উত্তরে মিঃ চ্যাটার্জি হাসিয়া উঠিলেন, পরে বলিলেন,–খুকীর পরীক্ষাটা হয়ে যাক—তারপর দেখে নিও। ও ছেলেকে আমি ছেলেবেলা থেকে জানি, আর জানতাম ওর বাবাকে। সেই বাপের শতাংশের এক অংশও যদি পেয়ে থাকে, তা হলে ও হবে অসাধারণ।
—কিন্তু খুকী ওর সঙ্গে মিশছেই না–বলে, মূর্খ, পাড়াগেঁয়ে।
–মূর্খ তো নয়ই, পাড়াগেঁয়েও নয়। আমি দুচারটা কথা কয়েই বুঝেছি। কিছু ভেবো তুমি, আমি ওকে পরশু থেকেই আমার ব্যবসায়ে লাগাব, আর তোমার খুকী ইতিমধ্যে পরীক্ষাটা দিয়ে নিক। তারপর দুজনকে শিলং-এ নতুন বাড়ীটাতে দেব পাঠিয়ে—সব ঠিক হয়ে যাবে।
–আচ্ছা, পাঁচালী, ছড়া এসব পড়ে কেন? ইংরাজী না জানুক বাংলা ভালো বই, মাসিকপত্র, এসব তো পড়তে পরে?
তুমি বোলো সেকথা। আর ইংরাজী যে একেবারে জানে না, তা তো নয়, যা জানে তাতে আমার অফিসের কাজ চলে যাবে। আর তোমার ঐ আধুনিক সমাজের ধরণাধারণ শিখতে মাসখানেকের বেশী লাগে না। আমি ওকে আপ-টু-ডেট করে দিচ্ছি। ভেবো না তুমি।ক
মিসেস্ চ্যাটার্জি কতকটা আশ্বস্ত হইয়া শয়ন করিলেন।
পরদিন মিসে চ্যাটার্জি তপনকে চা খাওয়াইতে বসাইয়া বলিলেন,–তুমি পাঁচালী কেন পড় বাবা? খুকীর বিস্তর মাসিক পত্রিকা আছে—সেইগুলো পড়ো। ভাল বাংলা বই পড়ো, বুঝলে।
উত্তরে তপন স্মিত হাস্যে কহিল,–পাঁচালী বাংলার আদি সাহিত্য মা, ওর ওপর এত রাগ কেন আপনাদের।
-না বাবা, আজকাল ওগুলো আর চলে না কিনা, তাই বলছি আধুনিক সমাজে ওর কদর নেই।
—কিন্তু আমি আধুনিক নই মা, অত্যন্ত প্রাচীন, আপনার শ্বশুরের মতন প্রাচীন। আর ঐ পাঁচালীখানা আপনার শ্বশুরমশায়ের—আপনারই বাড়িতে পেয়েছি কাল।
স্নিগ্ধ মধুর হাসিয়া মিসেস্ চ্যাটার্জি বলিলেন,—ওঃ তাই বলে বাবা তুমি শশুর—আবার ফিরে এলে বুঝি?
তপন মৃদু হাসিয়া বলিল,–হ্যাঁ মা, এবার ছেলে হয়ে এলাম।
মিসেস চ্যাটার্জি যেসমাজে বাস করেন সেসমাজে এরূপকথার চলন বিশেষনাই,সেখানে কথাবার্তার স্রোত আন্তরিকতাহীন কৃত্রিমতারমধ্যে বহিয়া যায়। কিন্তু সেসব হেঁদোকথা এমন করিয়া তো মনকে আকর্ষণ করে না, এ যেন নিমেষে আপন করিয়া লয়। তপন যেন ক্রমশ তাহার পুত্রহীনতার স্থানটিকে জুড়াইয়া দিতেছে। এমন সুন্দর ছেলেকে তাহার খুকী গ্রহণ করিবে না। নিশ্চয় করিবে। খুকীর পরীক্ষাটা হইয়া যাক—তারপর মিসেস চ্যাটার্জি খুকীর উপর চাপ দিবেন। তপন তত বাড়ীতেই রহিল। ব্যস্ত হইবার কিছু কারণ নাই।
পরদিন সাহেব কোম্পানীর দোকানের কোট-প্যান্টালুন পরাইয়া মিঃ চ্যাটার্জি তপনকে নিজের অফিসে লইয়া গেলেন। তপন এখন হইতে তাহাকে কাজ কর্মে সাহায্য করিবে।
অতি প্রত্যুষে উঠিয়া আপনার টু-সীটার খানায় খানিকটা বেড়াইয়া আসিয়া তপতী স্নান করে এবং বাপের সহিত চা খাইয়া পড়িতে বসে। তপন সে সময় আপনার ঘরে স্নান করিয়া পূজা করিতে থাকে। যখন খাইতে আসে তখন একমাত্র মিসেস, চ্যাটার্জি ছাড়া আর কেহই থাকে না।
খাইয়াই তপন বাহির হইয়া যায়, বহুস্থানেই তাহাদের কোম্পানীর কন্ট্রাক্টে বাড়ী নির্মিত হইতেছে, তাহাই দেখিতে। ফিরিয়া যখন আসে তখন তপতী খাইয়া বিশ্রাম করিতেছে আপনার ঘরে। তপন মধ্যাহ্নে ভোজন সারিয়া আবার বাহির হয় অফিসে। বিকাল সাড়ে পাঁচছটায় ফিরিয়া আসে জল খাইবার জন্য। তপতী তখন কোনদিন বন্ধুদের লইয়া বাহিরে বেড়াইতে গিয়াছে, কোনদিন বালনে টেনিস খেলিতেছে, কোনদিন হয়ত বন্ধুবান্ধবদের সহিত সঙ্গীতের আসর জমাইয়া তুলিয়াছে।তপনের সহিত তাহার সাক্ষাতের অবরনাই,ইচ্ছে তো নাই-ই। দৈবাৎ উহা ঘটিলেও ঘটিতে পারিত, কিন্তু তপতী যতখানি এড়াইয়া চলে, তপন এড়াইতে চায় ততোধিক। বৈকালিক জলযোগ সারিয়া তপন পুনরায় বাহিরে চলিয়া যায় এবং ফিরিয়া আসে রাত্রি সাড়ে দশটার আগে নয়।
মিষ্টার বা মিসেস চ্যাটার্জি তাহাকে এতখানি পরিশ্রম করিতে দিতে চান না, কিন্তু তপন মৃদু হাসিয়া বলে,—গরীবের ছেলে মা আমি খেটে খেতেই তো জন্মেছি। মিসেস চ্যাটার্জি ক্ষুব্ধস্বরে বলেন,—সে যখন ছিলে বাবা, এখন তো তোমার কিছু অভাব নাই, এত খাটুনি কমাও তুমি। তপন আরও মধুর করিয়া উত্তর দেয় বাবাকে একটু সাহায্য করার জন্য আমি চেষ্টা করছি মা,আমার বিদ্যে-সাধ্যি অল্প, তাই খুব সাবধানে কাজ করি, যাতে ভুল কিছু না হয়। খাটুনি আমার কিছু লাগে না মা।
মিসেস চ্যাটার্জির আর কিছু কথা যোগায় না। অনেকক্ষণ পরে তিনি বলিলেন,–তোমার জন্য একটা গাড়ী কিনে দিই বাবা।
-–কি দরকার মা? ট্রামে তো দিব্যি যাচ্ছি-আসছি।