এখনও তপন তাহাদের উপর এতটা সহানুভূতি কেন দেখায়—তপতী ভাবিয়া পাইতেছে না। মিঃ রায়কে সে লইয়া আসিল তপনকে আঘাত করিতে, আর তপন কিনা পরম যত্নে তাহারই সেবা করিতেছে। এতটুকু বিচলিত হইল না, লোকটা আশ্চর্য!
—পাইনকন আপনার কি রকম লাগছে?—তপতী প্রশ্ন করিল নীরবতাটা অসহ্য বোধ করিয়া।
সহাস্যে তপন উত্তর দিল,–মায়ের মুখের প্রশান্ত-স্নিগ্ধতার মতো স্নেহমাখা।
দূরের একটা আবছা পাহাড়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া তপতী কহিল-ঐ পাহাড়টা?
তপন নিম্নকণ্ঠে উত্তর দিল,দুঃখের দিনে সুখের স্মৃতির মতো বিষাদময়।
কয়েকটা পুষ্পিত বৃক্ষের দিকে তাকাইয়া তপতী বলিল,–ঐ ফুলবীথিকা?
রূপসী মেয়ের সিঁথির মতোই সুন্দর সুকুমার, ওদের সীমান্তের শোভা অক্ষয় হোক!
তপতী হার মানিয়া গেল।
একটা নিঝরিণীর দিকে আঙ্গুল তুলিয়া তপতী মিঃ রায়কে কহিল—এবার আপনি বলুন ঐ ঝরণাটা কেমন লাগছে।
মিঃ রায় কহিলেন—আপনার দোদুল্যমান বেণীর মতন।
হাসিয়া তপতী কহিল,–ইউনিভার্সাল হলো না। আপনি বলুন তো তপনবাবু।
—মৌন গিরিরাজের মুখর বাণী, বিষন্না বনানীর আনন্দ-কলগান, স্থিরা ধরিত্রীর অস্থির আঁখিজল…
একটা খাসিয়া মেয়ে দূরে বসিয়া আছে, তপতী কহিল,বলুন মিঃ রায় ঐ মেয়েকে কেমন লাগছে?
মিঃ রায় বলিলেন,—ওঁর সঙ্গে এ বিষয়ে পাল্লা দেওয়া অসম্ভব। তবু বলছি—নির্জন পাহাড়ের পটভূমিকায় যেন একখানি জীবন্ত ছবি।
তপতী খুসী হইয়া কহিল,খুব নতুন না হলেও সুন্দর। এবং আপনারটা বলুন!তপতী অনুরোধ করিল তপনকে।
তপন কহিল,—কিন্তু আপনারও একটা বলবার আছে আশাকরি, বলুন সেটা।
তপতী কহিল—অলকার অলিন্দে বিরহিনী বধু—এবার আপনারটা বলুন।
তপন প্রশংসমান দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া কহিল চমত্তার। আমারটা আর থাক।
–না–বলুন—বলতেই হবে—তপতী খুকীর মতো আবদার ধরিল।
আমি যদি অদ্ভুত কিছু বলি?—তপন মৃদুমধুর হাসিল।
তাই বলুন-যা আপনার ইচ্ছে বলুন! তপতীর আগ্রহ অদমনীয় হইয়া উঠিতেছে।
তপন বলিল,–মরণের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস, জীবনেব যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী
সরু রাস্তাটি চলিয়া গিয়াছে খাসিয়া-পত্নীর দিকে। তপন হাসিমুখে নমস্কার জানাইয়া চলিয়া গেল। তপতী পরমাশ্চর্য্যের সহিত কবিতাটির টীকা করিতে আরম্ভ করিল মনে মনে। কী বলিয়া গেল তপন ঐ কবিতার মধ্যে? তপতী চিন্তা করিতেছে দেখিয়া মিঃ রায় কহিলেন,—ওর কবিত্ব আপনাকে মুগ্ধ করলো নাকি, মিস চ্যাটার্জী?
—-জেলাস হবেন না, মিঃ রায়। ওর কবিতায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আর ও জেলাস হয় না।
–না, না, জেলাসি কিসের? ও তো আপনাকে স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়েছে, ও কি যোগ্য আপনার?
তপতী তড়িতাহত হইয়া উঠিল। স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়াছে। না তপতী মুক্তি চাহিয়াছিল। চাহিবার পূর্বে সহস্র অপমান সহ্য করিয়াও তপন তাহাকে মুক্তির কথা বলে নাই। মুক্তি দিবার সময় ও বারংবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, এবং মুক্তি দিয়া অজস্র উদ্বেলিত ক্রন্দনে পরিপ্লাবিত করিয়া দিয়াছিল তাহার পূজার বেদীমূল!
তপনের অযোগ্যতা কোথায়! ঐ সুন্দর আনন্দশ্রী, ঐ অদৃষ্টপূর্ব সংযম, ঐ হীরকদীপ্ত বাক্যালাপ-তপতীর অন্তর যেন জুড়াইয়া যাইতেছে। একমাত্র অপরাধ তপনের, সে দুই লক্ষ টাকার হিসাব দেয় নাই। নাই দিল—টাকা তো সে চুরি করিয়া লয় নাই, চাহিয়া লইয়াছে।
তপতী বাড়ি ফিরিতে চাহিল। মিঃ রায় আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছেন। তপনকে তাঁহার অত্যন্ত ভয় করিতেছে। লোকটা অদ্ভুত প্রকৃতির হিমাচলের মতো অবিচল, আবার সাগরের মতো সঙ্গীতময়। কহিলেন তিনি,আর একটু বেড়ানো যাক-না—আসুন ঐদিকে-তপতীর ভালো লাগিতেছেনা। নিতান্ত নিশ্চিন্ততায় সে যে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদকে এমন করিয়া নিঃশেষে মুছিয়া দিতে পারে, সে কে! মানুষ না পাথর–না দেবতা?
-আর বেড়ানো মা, মিঃ রায়চলুন! বাড়ি যেতে হবে আমায়-বলিয়াই তপতী ফেরার পথ ধরিল। অগত্যা মিঃ রায়ও ফিরিলেন। সারা পথ নীরবে তপতী হাঁটিয়া আসিল; মিঃ রায়ও কোনো কথা বলিতে পারিলেন না।
রাত্রি গভীর।
আপন কক্ষে বসিয়া তপতী চিন্তা করিতে লাগিল তপনের প্রত্যেকটি ব্যবহার, প্রত্যেকটি কথা—যতদূর মনে পড়ে। মনে পড়ল, তাহাকে জন্মদিনে দেওয়া অশোকগুচ্ছের সহিত ঋষিজনোচিত আশীর্বাদ; মনে পড়িতেছে অদ্যকার কবিত্বময় আশীর্বাণী; মনে পড়িয়া গেল—জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী কি বলিয়া গেল তপন ঐ কথাটার মধ্যে? তপতীর বিরহে তপন এতটুকু বাথা পাইয়াছে, তাহা তো তপতীর কোনদিন মনে হয় নাই। কিন্তু আজিকার ঐ কথাটা হা, উহাই তপনের অন্তরবেদনার আত্ম প্রকাশ-মধুরতম, করুণতম কিন্তু বিষাক্ত জ্বালাময়।
তপতীর অন্তর তৃপ্তিলাভ করিতেছে। তপনের মর্মমাঝে তবেআজও আছেতাহার আসন।
ঠাকুরদা যদি একবার আসিয়া তপতীকে বলিয়া যান–প্রেমের নবীনতম বাণী তাহাকে শুনাইবে ঐ তপন, তবে তাহার আদরের তপতী আজ, বাঁচিয়াই যাইবে!–তপতী আচ্ছন্নের মতো শয্যায় পড়িয়া রহিল। চিন্তাশক্তি তাহার বিলুপ্ত হইয়াছে যেন!
সকালে নিয়মিত সময়ে মিঃ রায় আসিবামাত্র তপতী জানাইল, বেড়াইতে যাইবে না। মিঃ রায় অত্যন্ত ক্ষুন্ন হইয়া কহিলেন,–বেড়াইবার জন্যই তোএখানে আসা মিস চ্যাটার্জি।
—সেটা আপনাদের পক্ষে। আমার আসা অপমানের প্রতিশোধ নিতে।
—কে করেছে অপমান আপনাকে? মিঃ রায় অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন।
–ঐ তপন! ও আমার নারীকে নির্মমভাবে পদদলিত করেছে; আমার প্রেমধারাকে পাষাণের মতো প্রতিহত করছে, আমার বন্ধনকে বিদায়ের নমস্কারে বঞ্চিত করেছে বলে গেছে-আমার বিদায় অশ্রু রাখিলাম, লহো নমস্কার।