মা তপতীকে খবরটা জানাইলেন না। আগে আসুক তপন, মা তাহার সহিত কথা বলিবেন, তার পর যাহা হয় করা যাইবে। সত্য বলিতে কি, এখনও তপনের দিকে মন তাঁহার স্নেহাতুর হইয়া রহিয়াছে।
প্রতিদিন সকালে মিঃ রায় আসেন তপতীর সহিত বেড়াইবার জন্য। সেদিনও তপতী সাজিয়া-গুজিয়া মিঃ রায়ের সহিত বেড়াইতে গেল।
পথের ধারে একটা গাছে অজস্র ফুল ফুটিয়াছে, মিঃ রায় একটা ডাল নোয়াইয়া ধরিলেন—তপতী ফুল তুলিয়া খোঁপায় খুঁজিতে লাগিল আর দুই-চারিটা ফুল ছুড়িয়া মিঃ রায়কে মারিতে লাগিল। মিঃ রায় হাসিয়া বলিলেন,–বড্ড বেশী সুইট…
তপতী আর একগোছা ফুল ছুড়িয়া দিয়া কহিল,দেখছি কতখানি আমার ইডিয়টের উইট?
কে একজন মুটের মাথায় বাক্স-বিছানা দিয়া আসিয়া পড়িয়াছে খুব কাছে! তপতী যেন ভূত দেখিয়া চমকিয়া উঠিল—তপন। নীরবে তপন পাশ কাটাইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু তাহার মুখের বিদ্রূপ-হাসিটা বিদ্যুতের মতোই তপতীর চোখে লাগিল। তপতী চাহিয়াই রহিল তপনের দিকে। মিঃ রায় কহিলেন,—চেনেন নাকি।
—হাঁ–বলিয়া তপতী একটা উঁচু পাথরের উপর উঠিয়া দেখিতে লাগিল তপন কোন দিকে যায়। কিন্তু পথের বাঁকে তপন অদৃশ্য হইয়াছে। নিশ্চয় তাহাদের বাড়ি যাইতেছে। তপতী ভাবিতে ভাবিতে আরো খানিক বেড়াইল। ও কেন এখানে আসিল? আর আসিয়াই দেখিল, তপতী মিঃ রায়ের সহিত কেমন স্বচ্ছন্দে খেলা করিতেছে। যদি দেখিয়াছে তো ভালো করিয়াই দেখুক। যে বিদ্রুপের হাসি সে হাসিয়া গেল, তপতী তাহাকে গ্রাহ্যমাত্ৰ করে না। হয়তো সে ভাবিয়াছিল, তাহার বিরহে তপতী বুক ফাটিয়া মরিবে! হায়রে কপাল!
তপতী মিঃ রায়কে লইয়াই গৃহে ফিরিল। ইচ্ছাটা, তপনকে ভালো করিয়াই দেখাইয়া দিবে, তপতী তাহার অপেক্ষায় বসিয়া নাই;-তাহার জীবনে সাথীর স্থান অনায়াসে পরণ করিয়া লইতে পারে।
—কৈ মা, তোমার সেই ভণ্ড ছেলেটিকে লুকালে কোথায়? বার করো!
মা বিস্মিত হইয়া বলিলেন,–তপন এল নাকি?
–হ্যাঁ। কিন্তু কৈ সে? এখানে আসেনি?
–না, হোটেলে উঠবে বলেছে। এখানে কাল আসবে বিজয়ার প্রণাম করতে।
তপতী অত্যন্ত বিস্মিত হইল। হোটেলে উঠবে কেন? এখানে আসতে তো কেহ বারণ করে নাই। মাকে শুধাইল, তুমি জানতে ও আসবে?
–হ্যাঁ, আমিই তো টেলিগ্রাম করেছিলাম আসতে। তোর সঙ্গে একটা পাকাপাকি কথা হয়ে যাক—আর মুক্তিনামাটাও করিয়েনি।
—বেশ। কিন্তু বলে রাখছি, কথা যা কইবার আমি বলবো।
মা কিছু বলিলেন না। বিকালে তপতী সুসজ্জিত হইয়া মিঃ রায় সমভিব্যাহারে চলিল তপনের সহিত দেখা করিতে হোটেলে। তাহার আর সবুর সহিতেছিল না। মিঃ রায়কে লইয়া গিয়া তপতী এখনি দেখাইয়া দিবে যে কত সহজে তাহার যোগ্য স্বামী সে লাভ করিতে পারে।
তপন একটা জানালার ধারে দাঁড়াইয়া পাইন-বনের দিকে চাহিয়া ছিল।
নমস্কার, তপনবাবু! প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, আমাদের ওখানে না-ওঠার জন্য। অনর্থক একটা ডিস্টারবেন্স ক্রিয়েট না করে ভালোই করেছেন।
তপন ফিরিয়া চাহিয়া প্রতিনমস্কার করিয়া বলিল,আসুন! মীরার কাছে শুনেছিলাম আপনি অসুস্থা। আশা করি ভালো আছেন এখন?
হ্যাঁ ভালো। আসুন মিঃ রায়, আলাপ করিয়ে দিই। এর সঙ্গে আমার হিন্দুমতে বিয়ে হয়েছিল একদিন। আর তপনবাবু, ইনি মিঃ বি. সি. রায়, আই-সি-এস বাঙলায় অনুবাদ হচ্ছে বোকা চন্দ্র রায়—তপতী হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, ওঁর সঙ্গে আমার ভাবী সম্বন্ধটা আশা করি আপনি অনুমান করতে পারছেন?
মৃদুহাসির সহিত নমস্কার করিয়া তপন বলিল, বড় সুখী হলুম, মিঃ রায়। প্রার্থনা কবি আপনাদের জীবনে যেন নেমে আসে পাইন বনের শীতল শান্তি, আর এই নিঝরিণীর নন্দিত কল্লোল। বসুন, চা খান একটু।
তপন বয়কে চা আনিতে বলিল।
আশ্চর্য!বাংলা ভাষাটা উহার কণ্ঠে কী বিদ্যুতের মতোই খেলিতে থাকে। কী কবিত্বময় ভাষা!
তপন মিঃ রায়কে বলিল, কোথায় কর্মস্থান হলো আপনার? বাঙলার বাহিরের নয় তো?
না, নদীয়ায়। বড় ম্যালেরিয়ার দেশ। তাই ভাবছি—
ম্যালেরিয়া বুভুক্ষু ব্যাধি। আপনাদের তো কিছু ভয়ের কারণ নেই?
অনুপ্রাস না দিয়ে কি আপনি কথা বলেন না, তপনবাবু? তপতী প্রশ্ন করিল।
অনুপ্রাসটা চ্যবনপ্রাসের মতো উপাদেয় আর উপকারী। তপন মৃদু হাসিল।
কথা বলার আটটি আপনি চমৎকার আয়ত্ত করেছেন। তপতীও মৃদু হাসিল।
চা আসিলে তপন স্বহস্তে তিন পাত্র প্রস্তুত করিয়া মিঃ রায়কে ও তপতীকে দুই পাত্র দিয়া নিজে এক পাত্র লইয়া। কি কথা বলিবেন মিঃ রায় বুঝিতে পারিতেছেন না। তপতীও কিছুটা উন্মনা হইয়া রহিয়াছে।
তপন কহিল,—মীরা আপনার কাছে বড় অন্যায় করেছে, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। আপনি শিক্ষিতা, ওর মতো একটা পন্নী-মেয়ের দোষ নেবেন না।
তপতীর বিস্ময় ক্রমাগত বাড়িয়া যাইতেছে। তপনের ইহাও কি ভণ্ডামী? সংযতকণ্ঠে কহিল, না, কিছু মনে করিনি। আপনি আমাদের ওখানে যাবেন না?
আজ একটু খাসিয়া-পল্লীতে যাবার কথা আছে, এখনি বেরুবো।
সেখানে কী দরকার? চলুন তাহলে আমরাও যাবো ঐদিকে।
তপন বিস্মিত হইল তপতীর এই আহ্বানে। কিছু না বলিয়া সে বাহির হইল উহাদের সঙ্গে। তিনজনেই নির্বাক চলিতেছে; প্রত্যেকের মন যেন একটা গভীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত।
পথের ধারে একটা উঁচু ডালে গুচ্ছ-গুচ্ছ ফুল ফুটিয়া আছে। তপতী মিঃ রায়কে বলিল,—দিন না ফুলটা পেড়ে?—মিঃ রায় দুএকবার লাফ দিয়াও ডালটা ধরিতে পারিলেন না। আপনার চাদরের খুঁটে একটা ছোট পাথর বাঁধিয়া তপন ডালের উপর হুঁড়িল। সরু ডালটা নুইয়া পড়িতেই মিঃ রায়কে ডাকিয়া বলিল—তুলে নিন ফুলটা—মিঃ রায় ঘাড় উঁচু করিয়া ফুলটি তুলিতে যাইতেই তাহার চোখে পড়িল ডালের ঝরা একটা কুটা। মিঃ রায় ফুল না তুলিয়াই চোখে রুমাল চাপিয়া মাথা নীচু করিলেন। তপনই নিজেই শাখাসমেত ফুলটি ছিঁড়িয়া আলগোছা তপতীর হাতে ফেলিয়া দিল, তারপর পরম যত্নে রায়ের চোখের উপরের পাতাটি নীচের পাতার মধ্যে ঢুকাইয়া চোখ মর্দন করিয়া দিতেই কুটাটা বাহির হইয়া আসিল।