নাক বাঁকাইয়া তপতী কহিল,—তুমি যাও, আমার প্রণাম করিবার ঢের জায়গা আছে।
তপতী গিয়া গাড়ীতে উঠিল। তপতীর দুই একজন বন্ধু, যাহরা তাহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল, তাহারা কিন্তু তপনকে একবার দেখিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। তপনের কক্ষদ্বারে গিয়া দেখিল, ক্ষৌম বস্তু-পরিহিত, উত্তরীয়-আবৃত দেহ তপন পিছন ফিরিয়া পূজা করিতেছে। তাহার মুণ্ডিত মস্তকের উপর লাউয়ের বোঁটার মতো টিকিতে একটা গাঁদা ফুল। তরুণীর দল আর স্থির থাকিতে পারিল না। একটা ছোট কঁচি আনিয়া টিকিটি আমূল ছটিয়া দিল। হাসির উচ্ছল শব্দে মুখ ফিরাইয়া তপন দেখিল, ঘরে চাঁদের হাট। সে পুনরায় মুখ ফিরাইয়া পূজা করিতে লাগিল। তাহার চন্দনচর্চিত মুণ্ডিত মুখশ্রী আধুনিক আলোক-প্রাপ্তদের মোটেই ভালো লাগিল না। তাহার উপর তপন কয়েকদিনের অসুস্থতার জন্য দাড়ি কামায় নাই, ইহা তাহার দ্বিতীয় অপরাধ। সর্বোপরি সে যে পুস্তকখানির উপর পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করিতেছিল, সকলে সবিস্ময়ে দেখিল, লালচে রং-এর কাগজের মলাটে তাহার নাম লেখা হারু ঠাকুরের পাঁচালী।
ঐ বটতলার নিদারুণ অশ্লীল বই তপন পড়ে এবং সরস্বতী পূজার জন্য উহারই উপর পুস্পাঞ্জলী অর্পণ করে, ইহা অপেক্ষা কদর্যতার পরিচয় আর কি হইতে পারে। উহার আর কোন বই নাই, আর কিছু পড়িবার যোগ্যতা নাই! কি হইবে উহার সহিত রসিকতা করিয়া। তরুণী দল বাহিরে আসিল মুখ টেপাটেপির হাসিতে। তগতীর অদৃষ্ট সম্বন্ধে যাহারা এতাবৎ ঈর্ষাপরায়ণা ছিল, তাহারা বেশ একটু আত্মপ্রসাদ লাভ করিল, তপনের অর্বাচীনতাটা তাহারা আজ আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে।
গাড়িতে বসিয়া তপতী বিরক্তিতে তিক্ত হইয়া উঠিতেছিল। ঝঙ্কার দিয়া কহিল—এরকম দেরী করলে যাবো না আমি। রেবা মৃদু হাসিয়া বলিল—দেখে এলাম তোর বর-পাঁচালী পড়ছে। এবার সচিত্র প্রেম পত্তর আউড়ে চিঠি দেবে তোকে—যাও পাখী বলো তারে—।
সকলে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। একজন তপনের কর্তিত টিকিটি আনিয়াছিল, তপতীর অঞ্চল-বিদ্ধ ব্রোচটিতে সেই টিকিটি আটকাইয়া দিয়া কহিল–তোর বরের মাথার ধ্বজারা বুকে খুঁজে!
আবার হাসি! রাগে তপতীর যেন বাকরুদ্ধ হইয়া গিয়াছে; রোষকষায়িত নয়নে সে ড্রাইভারকে ধমক দিল—জলদি চালাও-জলদি! বান্ধবীদের মধ্যে একজন সহানুভূতি দেখাইয়া কহিল,—তপু, কি করে জীবনটা কাটাবী তুই?
অন্যজন বলিল,–রিয়েলি, উই আর সো স্যরি।
তৃতীয়া বলিল,–মন্দই বা কি ভাই! বেশ হুকুম মতো চলবে, গা-হাত পা টিপে দেবে, মাঝে মাঝে পাঁচালী পড়ে শোনাবে, দরকার হলে রান্না-বান্নাটাও
হো হোকরিয়া হাসিতে হাসিতে আর একজন বলিল,–চেহারাটাও ঠিকরাঁধুনি বামুনের মতন।
তপতীর আপাদমস্তক জ্বলিতেছে, কিন্তু উপায় নাই। ইহারা যাহাকে দেখিয়া আসিয়াছে, সে ঐরকমই নিশ্চয়, বিরুদ্ধে তপতী কিছুই বলিতে পারে না। তাহার যত রাগ গিয়া পড়িল তাহার বাবার উপর। বাবা তাহার একি করিলেন? একটা নিতান্ত অশিক্ষিত, সভ্য সমাজে অপাংক্তেয় ছেলের সহিত তপতীর বিবাহ দিলেন। আশ্চর্য! ইহাই যদি বাবার মনে ছিল তবে তপতীকে তিনি এত লেখাপড়া শিখাইলেন কেন? তপতী তো ঠাকুরদার কাছে যতটুকু লেখাপড়া শিখিয়াছিল তাহাতেই বেশ চলিত। ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর তপতীকে কলিকাতায় আনিয়া তিনি কলেজে ভর্তি করিয়াছেন। তাহার জন্য গানের মাষ্টার রাখিয়াছেন,নাচের মাষ্টার রাখিয়াছেন। পাঁচটা সাতটা ক্লাবে তাহাকে ভর্তি করিয়া দিয়াছেন, এক কথায় সম্পূর্ণ আধুনিক ছাঁদে তপতীকে গড়িয়া তুলিয়াছেন তাহা কি ঐ পাঁচালী পাঠকারী টিকিওয়ালা গণ্ডমূর্খের জন্যই! বেশ—তপতী ইহার শোধ তুলিয়া তবে ছাড়িবে।
তপতীর ব্যবহার কয়েকদিন মিসেস্ চ্যাটার্জি লক্ষ্য করিতেছিলেন। আজ তাহার মুখে বিদ্রোহের বাণী শুনিয়া তিনি শঙ্কিত হইয়াই অপেক্ষা করিতেছিলেন। গভীর রাত্রে বাড়ী ফিরিয়া তপতী সীমাহীন তিক্ততার সহিত জানাইল, আমার বন্ধুরা তোমার জামাইয়ের কাছে যেন না যায়, বুঝেছে-তা হলে আমায় বাড়ীছাড়া হতে হবে।
—কেন? মা স্নিগ্ধকণ্ঠেই প্রশ্ন করিলেন।
-কেন! তপতীর কণ্ঠে অগ্নদগার হইল-কেন, তা জানো না! একটা হতভাগ্য মুখ লোককে ধরে এনেছো—টিকি রাখে, পাঁচালী পড়ে—আবার কেন! লজ্জা করলো না জিজ্ঞাসা করতে?
মা নিঃসহায় বোধ করিতে লাগিলেন। মুহূর্তে সামলাইয়া কহিলেন,—গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এসেছে, তাই টিকি রয়েছে, ওটা তুই হেঁটে দিস।
—তুমি ছাঁটো গিয়ে, ধুয়ে ধুয়ে জল খাবে—আর পাঁচালী শুনবে–।
—পাঁচালী পড়তে আমি বারণ করে দেবো, খুকী।
–কিছু তোমার করতে হবে না, শুধু এইটি করো যেন আমার কোন বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা না হয়, তাহলেই বাধিত থাকবে।
তপতী রোষভরে শয়নকক্ষে চলিয়া গেল। মা একবার তপনের কক্ষে আসিয়া উঁকি দিয়া দেখিয়া গেলেন, ক্লান্ত অসুস্থ তপন একক শয্যায় ঘুমাইতেছে। কক্ষের মৃদু আলোক তাহার প্রশস্ত ললাটে আসিয়া পড়িয়াছে—যেন রূপকথার রাজপুত্র, সোনার কাঠির ছোঁয়ায় এমনি জাগিয়া উঠিবে। মিসেস্ চ্যাটার্জি একটা নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলেন, এমন সুন্দর ছেলে, লেখাপড়া কেন যে শেখে নাই। পর মুহূর্তেই মনে পড়িল তপনের দারুণ অবস্থা-বিপর্যয়ের কথা। পিতার মৃত্যুর পর পিতৃহীন হইয়া তপনকে পাঠ্য পুস্তক বেচিয়া বাড়ী ফিরিতে হয়। কিন্তু কি-ই বা উহার বয়স? এখনো তে পড়াশুনা করিতে পারে।