ক্লান্ত তপন কখন এক সময় ঘুমাইয়া পড়িল।
০২. শহরতলীর সর্পিল পথ
শহরতলীর সর্পিল পথ ধরিয়া চলিয়াছে বিনায়ক। মন তাহার বিষাদখিন্ন। তার একমাত্র অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু তপনের অন্তরে বিষাক্ত কন্টক বিদ্ধ হইয়াছে। সে কাঁটা তুলিয়া ফেলার উপায় বাহির করা সহজ নহে, কারণ তুলিতে গেলে তপনের হৃদপিণ্ডটিকে জখম করিতে হয়। বিনায়ক ভাবিতেছে আর চলিতেছে। দিকে দিকে বাসন্তী শ্ৰী ফুটিয়া উঠিতেছে; মাঘ মাসের শেষ হইয়া আসিল। সরস্বতী পূজা, কিন্তু পূজার শ্রেষ্ঠ পুরোহিত তপন আসিবে না। বিনায়কের মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিল তপনের বিরুদ্ধে। কেন সে না দেখিয়া শুনিয়া বিবাহ করিতে গেল? মিঃ চ্যাটার্জির বিষয়-সম্পত্তির প্রতি তো তপনের লোভ নাই। লোভ তাহার কিছুতেই নাই। আজ দ্বাদশ বৎসর বিনায়ক তপনকে দেখিয়া আসিতেছে। অথচ সেই তপন কিনা এক কথায় মিঃ চ্যাটার্জির মেয়েকে বিবাহ করিয়া বসিল? যেমন কর্ম তেমনি ফল হইয়াছে। নইলে সারা বাংলা দেশে তপনের মতো ছেলের বধূ যোগাড় করা কিছুই কঠিন ছিল না।
বিনায়ক গভীর দুঃখের মধ্যে আত্মবঞ্চনার শান্তি লাভ করিতেছে, তাহার হাসি পাইল নিজের বোকামির জন্য। তপন কোনদিন বিনা কারণে কিছুই করে না। তপনের হৃদয়, আকাশের তপনের মতই জ্বলন্ত, জাগ্রত, জ্যোর্তিময়।
কারখানায় আসিয়া পড়িল বিনায়ক। খেলনা তৈয়ারীর ছোট কারখানা। তপনের মস্তিষ্কউদ্ভূত নানাপ্রকার খেলনা তৈরী হয় শিশুমনের উৎকর্ষতর উপযোগী করিয়া। তপনই ইহার জনক এবং বিনায়ক তাহার মালিক ও পরিচালক। তপন নিজের খাওয়া পরার যৎসামান্য খরচ ছাড়া কিছুই গ্রহণ করে না। কারণ সে একা, তাহার খরচ খুবই কম, আর বিনায়কের মা-ভাই-বোন আছে, বাড়ী ভাড়া করিয়া থাকিতে হয় এবং বাজার করিয়া খাইতে হয়।
বিনায়ককে একা আসিতে দেখিয়া শ্রমিকবর্গ উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিল, ছোটা কই বড়দাদাবাবু?
শ্রান্তকণ্ঠে বিনায়ক উত্তর দিল—অসুস্থ। তোমাদের জন্য মার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে দুলাইন কবিতা পাঠিয়েছে—
দীর্ণ জীর্ণ জীবনে তোমার বাসন্তী বিভা ছড়ায়ে দিও,
—দুঃখ-আর্ত বঞ্চিত প্রাণে নব যৌবনে আশ্বাসিও।
এইবার এসো ভাই সব, পূজায় বসি।
সকলেই ক্ষুব্ধ হইল, উদ্বিগ্ন হইল কিন্তু পূজার সময় হইয়াছে। বিনায়ক পূজায় বসিল। করজোড়ে কর্মীগণ উপবিষ্ট রহিল।
পূজা শেষে প্রসাদ বিতরণ করিয়া বিনায়ক বলিল—তোমাদের ছোটদা দুচারদিন আসতে পারবে না ভাই সব, অসুখের জন্য নয়, অন্য কারণ আছে। ভেবো না তোমরা।
–তিনি ভালো আছেন তো?
—হ্যাঁ, সামান্য সর্দি মতো হয়েছে। বিনায়ক একাকী ফিরিয়া চলিল। দুই পাশে কচুরীপানার জঙ্গল শুকাইয়া উঠিয়াছে। দূরে দূরে দুই একটা গাছে লাল ফুল ফুটিতেছে। বাসন্তীর আগমনে সবই যেন লাল হইয়া যায়, এমন কি তপনের হৃদয়টাও আজ রক্তে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। বিনায়ক নিশ্বাস ফেলিল একটা।
তপন, তাহার বাল্যবন্ধু তপন—জীবনে যে কোনদিন কোনরূপ অসৎ কার্য করে নাই, কাহারও মনে বেদনা দেয় নাই, জীবন-পণ করিয়া যে পরোপকারবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে, সেই তপনের জীবনে এমন দুর্বিপাক কেন ঘটিল? তপন না থাকিলে মাতা-ভ্রাতা-ভগিণীকে লইয়া বিনায়ক আজ ভাসিয়া যাইত। এম-এ পাশ করিয়াও যখন চল্লিশ টাকার চাকুরী জুটিল না তখন একদিন নিরাশনয়নে গড়ের মাঠে বিনায়ক বসিয়া ভাবিতেছিল, আত্মহত্যাই তাহাকে করিতে হইবে। ঠিক সেই সময় তপন রাস্তার উপর দাঁড়ানো মোটরগাড়ীর আরোহীগণকে বিক্রয় করিতেছিল তাহার স্বহস্তের প্রস্তুত খেলনা। বিনায়ককে ক্লান্ত অবসাদখি দেখিয়া সেই তো এই কারখানার পত্তন করে নিজের হাতের আংটি বেচিয়া। সেদিন ছিল তিন টাকা ভাড়ার একটি চালাঘর এবং দুইজন শ্রমিক বিনায়ক আর তপন। সে আজ আট বৎসর পুর্বের ঘটনা। আজ এই কারখানায় পঞ্চাশ জন শ্রমিক কাজ করে। প্রস্তুত খেলনা বিদেশী খেলনার সহিত প্রতিযোগিতা করে। নীট আয় মাসিক দুই শত টাকার কম নয়।
কিন্তু তপন ইহার কতটুকু অংশ গ্রহণ করিয়াছে। মাসে পনের টাকাও সে গ্রহণ করে নাই, বিনায়কের সংসার পালনের জন্য দান করিয়াছে। এই অসাধারণ বন্ধুবৎসল তপন আজ ভাগ্যের ফেরে ক্ষতচিহ্ন, আর্তহৃদয়-অথচ বিনায়ক তাহার কোন উপকার করিতে পারে না! হয়ত পারে! বিনায়ক দ্রুত পা চালাইয়া নিকটবর্তী একটি দোকানে আসিয়া কয়েক আনা পয়সা দিয়া ফোন করিল।
অসুস্থ তপন আসিয়া ফোনে বলিল—কি বলছিস বিনু?
–তুই আত্মপরিচয় কেন দিবিনে তপু–তাহলে সে তোকে ভালোবাসবে।
-না, তার দরকার নাই। যে আমায়, কুৎসিত দেখে ভালোবাসলে না, সে আমায় সুন্দর দেখে ভালবাসতে পারে না, যে আমায় মূর্খ ভেবে গ্রহণ করলে না, আমাকে পণ্ডিত দেখে গ্রহণ করবার তার আর অধিকার নেই। যদি সে অনা কাউকে চায় তবে তারই হাতে ওকে তুলে দেবো।
–কিন্তু তাহলে…।
—থাক বিনু—এসব ফোনে হয় না। তপন ফোন ছাড়িয়া দিয়াছে। বিনায়ক গভীর শ্রান্তিতে এলাইয়া পড়িল। বাড়ী আসিয়া যখন সে পৌঁছিল তখন একটা বাজিয়া গিয়াছে এবং স্নেহময়ী জননী তাহার আহার্য লইয়া বসিয়া ঢুলিতেছেন।
বিনায়ক খাইতে বসিল।
তপতী চ্যাটার্জি সাবানঘষা একরাশ চুলে লাল ফিতা বাঁধিয়া বাসন্তী রং-এর কাপড় পরিয়া সেতার কোলে চলিয়াছে কলেজ-হোস্টেলে সরস্বতী পূজা করিবার জন্য। সেখানে সে গাহিবে, নাচিবে এবং রূপের বিদ্যুতে সকলকে চমকিত করিয়া দিবে।
মা বলিলেন—খুকী, তপন ওঘরে সরস্বতী পূজা করছে যা প্রণাম করে আয়।