স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নালোকে তপনের দুটি চক্ষু জ্বালা করিয়া উঠিল। জীবনের কত সাধকত আশা আজই বুঝি চুর্ণ হইয়া যাইতেছে। তপনেরই অন্তর বেদনা যেন শিশিরে শিশিরে ঝরিতেছে। কিন্তু এই গভীর বেদনাকে এত শীঘ্র বরণ করিয়া লইবে তপন নাঃ–আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখা যাক। তপন বলিতে চাহিল,—ওগো, তুমি যাহা মনে করিয়াছ, তাহা আমি নহি,—আমায় সুযোগ দাও, আমি তোমার যোগ্য হইবাব চেষ্টায় জীবনপাত করিব।
তপন পুনরায় উঠিয়া দেখিতে লাগিল, তপতীব শষ্যালুষ্ঠিত সুকোমল দেহখানি। তপতী ঘুমাইয়া গিয়াছে। সুদীর্ঘ বেণী দুটি পিঠের উপর দিয়া নামিয়া কোমরের নীচে তলাইয়া গিয়াছে, যেন দুইটি কৃষ্ণকায় সর্প তাহাকে পাহারা দিতেছে। সুখসুপ্তির সুদীর্ঘ নিশ্বাস তপনকে জানাইয়া দিল—তপতী তাহার নহে, তাহার হইলে এত সহজে, এত নিরুদ্বেগে সে এমন করিয়া ঘুমাইতে পারি না।
চকিতে তপনের মস্তিষ্কে একটা বিদ্যুৎচিন্তা খেলিয়া গেল। তবে, তবে হয়ত যাহার সহিত তপতীর বিবাহ হইল না, তাহাকেই সে ভালোবাসে—কিম্বা-ভাবিতে গিয়া তপন অন্তরে শিহরিয়া উঠিল। যুগসঞ্চিত হিন্দুসংস্কারে গঠিত তাহার মন যেন কোন অতল বিষসাগরে ড়ুবিয়া যাইতেছে। একি হইল। তাহার সুন্দর সুনির্মল জীবনে এ কার অভিশাপ! সে তো ইহা চাহে নাই। ধনীর কন্যাকে বিবাহ করিবার লোভ তাহার কোনদিন ছিল না। কিন্তু যাক—তপন স্থির করিয়া ফেলিল, তপতীকে কিছুই সে বলিবে না। তাহার বাঞ্ছিতকে—যদি অবশ্য তপন ব্যতীত অপর কেহ তাহার বাঞ্ছিত হয়–ফিরিয়া পাইতে তপন সাহায্যই করিবে।
তপন সেই যে ভােরে উঠিয়া গিয়া তাহার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষটিতে শয়ন করিয়াছে, বেলা বারটা বাজিয়া গেল, এখনো ওঠে নাই। প্রথমে সকলেই ভাবিয়াছিল, ইহা বধূর সহিত রাত্রি জাগরণজনিত অনিদ্রার আলস্য। কিন্তু তপতী দিব্যি ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহার দেহমনে ক্লান্তির কোন লক্ষণ নাই দেখিয়া মা জিজ্ঞাসা করিলেন,–হারে তপন কখন ঘরে গিয়া শুয়েছে? এখনো উঠছে না কেন?
—আমি তার কি জানি। বলিয়া তপতী অন্যত্র চলিয়া গেল।
ইহাকে নবোঢ়ার লজ্জা মনে করিয়া সকলেই হাসিয়া উঠিল। কিন্তু মা চিন্তিত মুখে তপনের ঘরে আসিয়া দেখিলেন,—গা অত্যন্ত গরম-তপন চোখ বুজি পড়িয়া আছে। প্রথম ফুলবাসরের পরেই জামাইয়ের জ্বর-আধুনিক সমাজের মধ্যে বাস করিয়াও তপতীর মার মনের সাধারণ বাঙালী মেয়ের সংস্কার ইহাকে অমঙ্গল-সূচক মনে করিল। ব্যগ্র ব্যাকুল ভাবে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন-জ্বর কেন হলো বাবা? কখন থেকে হলো?
তপন চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখিল, শিয়রে জ্যোতির্ময়ী জননীমূর্তি। তাহার চিরদিনের স্নেহবুভুক্ষু মন কাঁদিয়া উঠিল–
স্নেহে-বিহ্বল করুণা ছলছল শিয়রে জাগে কার আঁখিরে।
তপন বিস্মিত হইয়া ভাবিতে লাগিল, এই মা, আর ঐ তার মেয়ে।ইহা অপেক্ষা বিস্ময়ের ব্যাপার তপন জীবনে আর দেখেনাই। স্নিগ্ধ শিশুকণ্ঠে সে উত্তর দিল—একটু ঠাণ্ডা লেগেছে মা, কিছু ভয়ের কারণ নাই, একটা দিন উপোষ দিলেই সেরে যাবে।
—ডাক্তার ডাকি বাবা। জননীর স্নেহ করপুট তপনের ললাটে নামিল।
-না মা ওষুধ আমি খাইনে—কিছু ভাবনা নেই আপনার। আমি কালই ভালো হয়ে যাবো মা—আপনার মঙ্গল হাতের ছোঁয়ায় অসুখ কতক্ষণ টিকতে পারে?
পুত্রবঞ্চিত শিক্ষিতা জননী এমন করিয়া মা ডাক কোনদিন শুনেন নাই। অন্তর তাহার বিমল মাধুর্যে ভরিয়া উঠিল।
আপনার গর্ভজাত পুত্রের স্থানেই তিনি তপনকে সেই মুহূর্তে বরণ করিয়া লইলেন, বলিলেন-কি খাবে বাবা, সাবু?
-না মা, সাবু আমি খেতে পারি নে, বেঙাচির মতো দেখতে লাগে।
—আচ্ছা বাবা, একটু গ্লাকমো দিই।–শুধু একটু গরম দুধ দেবেন মা,–এ বেলা আর কিছু খাবো না। আর আমি একা শুয়ে থাকবে আপনার খুকীর বন্ধুবা যেন আমায় জ্বালাতন না করে এইটুকু দেখবেন।
—আচ্ছা, তাদের বারণ করে দেবো।
মা চলিয়া গেলেন, তপন শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল। কুলহীন পারহীন চিন্তা সমুদ্রে সে যেন তলাইয়া যাইতেছে। কিরূপে আত্মরক্ষা করিবে আজ? এতাবৎকাল সে নিজের জীবনকে যেভাবে গঠিত করিয়াছে তাহাতে তপতীকে বিবাহ করিবার পর অন্য কাহাকেও গ্রহণ করা তাহার কল্পনারও অতীত, অথচ তপতীকে পাইবার সমস্ত আশাই বুঝি নির্মূল হইয়া গেল? কিন্তু মা! আশ্চর্য ঐ মহিমাময়ী নারী উহার গর্ভে জন্মিয়াছে সে, যাহাকে গত রাত্রে তপন দেখিয়াছে। যে নিষ্ঠুরা নারী শীতের রাত্রে একজনকে বাহিরের বারান্দায় রাখিয়া নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে ঘুমাইতে পারে! কিম্বা তপন ভুল দেখিয়াছে, সেইহার কন্যা নহে। কিন্তু যতদূর মনে হয়, ইনিই মা এবং এই সংসারের কত্রী। ইহারই কন্যা এত নিষ্ঠুর হইল কিরূপে? হিন্দুনারী হইয়াও আপনার স্বামীকে বুঝিবার চেষ্টা পর্যন্ত করিল না, বুঝাইবার সুযোগ পর্যন্ত দিল না। ইহার অন্তর্নিহিত রহস্য যতই ভীতিপ্রদ হউক, যেমনই কদর্য হউক, তপন তাহাকে আবিষ্কার করিবে। তারপর যথা কর্তব্য করা যাইবে।
ভাবিতে গিয়া তপন আতঙ্কিত হইয়া উঠিল।—যদি সে দেখে তপতী অন্যাস, তপতী তাহার অন্তরে অপরের মূর্তি আঁকিয়া পূজা করিতেছে—তপন কি করিবে? ভাবিতে গিয়া তপনের মনে হইল—হয়ত তাহাই সত্য, তপনকে তাহাই সহ্য করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে এবং তপতীকে সুযোগ দিতে হইবে তাহার বাঞ্ছিতকে লাভ করিবার জন্য। বর্তমানে ইহা অপেক্ষা আর অধিক কিছুই ভাবিবার নাই। যদি সত্যই সে কাহাকেও ভালোবাসে তবে তাহাকেই লাভ করুক। অন্যথায় তাহার কুমারী-হৃদয় একদিন তপনের কাছে ফিরিয়া আসিবে—সেই শুভদিনের জন্য অপেক্ষা করিবে তপন। যদি তাহাও না হয় তবে তপনের জীবন–সে তো চিরদিনই দুঃখের তিমির-গর্ভে চলিয়াছে, তেমনিই চলিবে।