—কিন্তু সম্মতি যার কাছ থেকে পাওয়া চাই, তিনি টয়লেটে ব্যস্ত; ঐ এসে পড়েছে। তপতী তর তর বেগে সিড়ি দিয়া নামিয়া আসিল। সুদীর্ঘ বেণী সর্পাকারে দুলিতেছে,
তাহার অর্ধেকটা আচ্ছন্ন করিয়া ধূপছায়া রঙেব অঞ্চলপ্রান্ত পিঠের উপর দিয়া কোমরের কাছে পড়িয়াছে। সমস্ত তনুলতা ঘিরিয়া একটা স্নিগ্ধ সুরভি। সকলে তাহাকে সহাস্যে
অভিবাদন করিল। একজন প্রশ্ন করিল,—পরীক্ষা নিশ্চয় ভালো দিলেন!
–হ্যাঁ, আজকার প্রোগ্রাম কি! অকাজে বসে থাকা?
-না, নিশ্চয় না। আজই আমরা ঠিক করবে আগামী মেঘদূত উৎসবে কে কি রোলে নামবেন। প্রথমে দুএকটা গান হোক একটু নাচও যদি হয় আপনার।
হাসির বিদ্যুৎ ছড়াইয়া তপতী কহিল–নাচ আজ নয়, বড় ক্লান্ত। পরশু বরং চলুন স্টিমার ভাড়া করে খানিকটা বেড়িয়ে আসি।
সকলে সমস্বয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল,–হুর্রে! এইতো চাই। থি চীয়ার্স ফর মিস চ্যাটার্জি।
তপতী আত্মপ্রসাদ লাভ করিবার অবকাশ পাইবার পূর্বেই মিঃ ব্যানার্জি শুধাইলেন—সেই ভদ্রলোকটির খবর কি, দ্যাট গুড, ওল্ড ম্যান?
মধুর হাসিয়া তপতী বলিল,–থাক, তার কথায় কি দরকার! ওর ওপর জেলাস হবার কোন দরকার নাই, ও আমাদের ছায়াও মাড়াবে না।
—গুড্। না মাড়ালেই আমরা খুশি থাকব।
তপতী এবং আরো অনেকের গান গাওয়ার পর আগামী উৎসবের কর্মসূচী প্রস্তুত হইল এবং আগামী কল্যকারও একটা খসড়া তৈরী হইল। রাত্রি অনেক হইয়াছে সকলে চলিয়া গেলে তপতী উপরে আসিয়া দেখিল, তপন খাইতে বসিয়াছে। মা সম্মুখে বসিয়া খাওয়াইতেছে। তপতীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া মা ডাকিলেন,—আয় খুকী খেয়ে নে। তপন ওদিকে মুখখানা এতই নীচু করিয়া দিয়াছে যে প্রায় দেখা যায় না। মা দেখিয়া বলিলেন,–খাও বাবা এত লজ্জা কেন।
তপতীর দিকে তপন পিছন ফিরিয়াই ছিল, সেই ভাবেই উত্তর দিল,লজ্জা না মা অনভ্যাস। খাওয়া হয়ে গেছে, উঠলাম।
—দুধ খাও নি বাবা এখনো।
—আজ আর দুধ খাব না মা, বড ঘুম পাচ্ছে। তপন মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেল। মিসেস চ্যাটার্জি তপতীকে বলিলেন, খাওয়ার পর তুই আজ ওর ঘরে গিয়ে শুবি খুকী।
তপতী অত্যন্ত বিরক্ত এবং কুদ্ধ হইযা বলিল,–তুমিও সেকেলে হয়ে যাচ্ছ মা। কোন ঘরে শুতে হবে, না হবে, আমি খুব ভালো জানি। আমি আর কচি খুকীটি নই।
মিসেচ্যাটার্জি অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া বলিলেন—সে কি খুকী, তোর মতলব কি তাহলে।
ব্যাপারটা অত্যন্ত বিশ্রী হইয়া উঠিতেছে বুঝিতে পারিয়া তপতী সাবধান হইয়া গেল। বলিল,–তুমি মিছেমিছি অত ভাব কেন। দিন পালিয়ে গেল নাকি? বলিয়া তপতী হাসিয়া উঠিল।
মা ভীতভাবেই বলিলেন,—কিন্তু আজই বা গেলি?
–না মা না, ভালো একটা দিনক্ষণ ঠিক করো। তোমার ঐ গোঁড়া বামুন জামাইয়ের কাছে কৃষ্ণপক্ষের দিনে নাই বা গেলাম।
মা খানিকটা প্রসন্না হইলেন। তাহারা দিনক্ষণ না-মানিলে কি হইবে তপন তো মানে! হ্যাঁ, সেই ভালো হইবে। একটা ভালো দিন তিনি ঠিক করিবেন।
তপতী আহার সারিয়া আপন কক্ষে গিয়া হাসিতে লুটাইয়া পড়িল। মাকে কত সহজে কঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু পাঁজিতে ভালো দিনের অভাব নাই এবং মা কালই বাহির করিবেন। আচ্ছা তখন অন্য মতলব খাটানো যাইবে। তপতী নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া পড়িল।
একখানা প্রকাণ্ড গাড়ি আসিয়া থামিল, নামিল তপন আর শিখা-বিনায়ক অভ্যর্থনা করিতে আসিয়া থামিয়া গেল; কর্মিগণ বিব্রত হইয়া উঠিল। মীরা ব্যতীত নারী অতিথি এখানে কখনো কেহ আসে নাই। বিনায়ক কোনরূপে নিজেকে সামলাইয়া একটা নমস্কার করিল। অন্যান্য সকলেই তাহার অনুসরণ করিল কোন প্রকারে। কিন্তু শিখা সহজ হাসিতে সকলকে চকিত করিয়া দিয়া বলিল–সব কিন্তু খুঁটিয়ে দেখাবেন বিনায়কবাবু, চলুন আগে অফিস দেখি আপনার।
কে এ? তপন যাহাকে বিবাহ করিয়াছে, সে নয় নিশ্চয়ই। তপনটা কি ফন্দিবাজ। কাহাকে লইয়া আসিতেছে কিছুমাত্র জানায় নাই। তপন বলিল–তুই ওর সঙ্গে ঘুরে সব দেখ ভাই শিখা, আমি ততক্ষণ একটা নতুন খেলনার নক্সা করি—কেমন? তপন গদীতে আসিয়া বসিল।
—আচ্ছা,—আসুন বিনায়কবাবু।
নিরুপায় বিনায়ক শিখাকে লইয়া কারখানা দেখাইতে গেল। ছোট ছোট যন্ত্রগুলি হাতেই চলে। একটা মাত্র বিদ্যুৎ পরিচালিত কল রহিয়াছে। যতদূর সম্ভব শিখা বুঝিতে চেষ্টা করিল। বিনায়ক ধীরে ধীরে বলিয়া গেল এই কারখানা প্রতিষ্ঠার করুণ ইতিহাস, তাহার দরিদ্র জীবনের কাহিনী। লাজুক বিনায়ক নত মুখেই কথা কহিতেছে; বড় সুন্দর লাগিল শিখার। কোনরূপ ঔদ্ধত্য নাই, সহজ অনাড়ম্বর লোকটি। বন্ধুবাৎসল্যে চোখ দুইটি ছলছল করিতেছে। বিনায়ক বলিয়া চলিল,—তপনকে যদি না পেতাম শিখা দেবী, তা হলে হয়ত বিনায়কের অস্তিত্বও মুছে যেতো। কিন্তু তপনের কিছুই করতে পারলাম না।
–করতে পারলাম না কেন! চেষ্টা করেছেন?
—কি চেষ্টা করবো? তপন তো হাত পা বেঁধে দিয়েছে?
শিখাও নীরব হইয়া গেল। তপনকে সে এই কয়দিনে ভালো রকমই চিনিয়াছে।
খানিক পরে বিনায়ক জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি চেনেন তাকে, কিসের অত অহঙ্কার তার।
–শুধু চিনি নয় সে আমার বিশেষ বন্ধু। আপনার মতো আমারও হাত-পা দাদা বেঁধে দিয়েছেন।
বিনায়ক শুধু বলিল,–হুঁ।
শিখা বলিল,–কিন্তু আপনি ভাববেন না কিয়বাবু, যতদূর জানি তপতী এখনও নিষ্কলঙ্ক আছে। সে নিশ্চয়ই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। বিনায়ক আবার একটা ই দিল। একটি কিশোর কর্মী আসিয়া বলিল,–বড়দাদাবাবু, ছোট-দা ডাকছেন আপনাদের।